ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ যাচ্ছে বিভিন্ন খাতে। কখনও ব্যবসা বা শিল্প খাতে ব্যবহার হচ্ছে। আবার কখনও যাচ্ছে অন্য কোথাও। এতে ঋণ ফেরত না আসায় খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে তা জানা যাচ্ছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ঋণের অর্থের সুবিধাভোগী কারা তাও জানা যাচ্ছে না। ব্যাংক পরিদর্শন কার্যক্রম সীমিতকরণ ও কিছু ক্ষেত্রে পুরো বন্ধ থাকায় এ তথ্য জানতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণসহ অর্থের ব্যাংকিং কার্যক্রমের পুরোটাই পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যে কাজে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে, সেখানে ওই অর্থ ব্যবহার হচ্ছে কি না। এটি দেখতে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান ও শাখা অফিসে সরেজমিন পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
নির্দিষ্ট করা উদ্দেশ্যের খাতে ঋণের অর্থ ব্যবহার না হলে বা সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য খতিয়ে দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় দেখা হয় অর্থের সর্বশেষ সুবিধাভোগী কারা। ব্যাংকিং ভাষায় এটিকে ‘এনডিউজ’ বলা হয়। এই বিশদ পরিদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে জানা সম্ভব হয় ঋণের সুবিধাভোগী কারা। অর্থাৎ ভুয়া বা ভিন্ন নামে ঋণ সৃষ্ট হলেও প্রকৃতপক্ষে এর পেছনে কে কলকাঠি নেড়েছেন বা চূড়ান্তভাবে অর্থের সুবিধাটি নিয়েছেন।
কিন্তু সম্প্রতি এই বিশদ পরিদর্শন কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এখন প্রয়োজন অনুযায়ী পরিদর্শন করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শতকোটি টাকা ঋণগ্রহীতার এটি কিস্তির অর্থ পরিশোধ করা হয় চেকের মাধ্যমে। কিন্তু চেকটি ওই গ্রহীতার ব্যাংক হিসাবের নয়। ভিন্ন একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেক দিয়ে ওই অর্থ পরিশোধ করা হয়। ওই চেকের সূত্র ধরে যাচাই করে দেখা হয়, জমা দেওয়া চেক হচ্ছে দ্বিতীয় ব্যাংক থেকে ওই গ্রাহকের নেওয়া ঋণ। ওই ঋণটিও সৃষ্ট করা হয়েছে, প্রথম ব্যাংকের অর্থ পরিশোধের জন্যই।
দুটি ব্যাংকে এরকম আরও কোনো ঘটনা আছে কি না, তা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি চান। কিন্তু প্রভাবশালী ঋণ গ্রহীতার বিষয় হওয়ায় ওই পরিদর্শন আজও চালানো হয়নি।
আবার বেসরকারি খাতের আরেক ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হয়। কিন্তু এই ঋণের তথ্য গোপন করা হয়। পরে তা খেলাপিতেও পরিণত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এটি ধরা পড়লে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ঋণটি ওই পরিচালকের ভাগ্নের নামে স্থানান্তর করা হয়। ফলে এই ঋণ নিয়ে অধিকতর কোনো তদন্ত বা রিপোর্ট হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সম্প্রতি আলোচনায় আসা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট হয়েছেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থেকে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নামে বের করে নিয়েছেন দুই হাজার ২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে পিকে হালদার নিজ ও আত্মীয়ের নামের প্রতিষ্ঠানে নিয়েছেন এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন সূত্রে শোনা যাচ্ছে, পিকে হালদার কানাডায় পালিয়ে গেছেন।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সম্পর্কে সম্প্রতি আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিদর্শন নীতিমালায় পরিবর্তন আনায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, তা চিহ্নিত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
শুধু প্রতিষ্ঠানটি থেকে এক হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা কাদের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়। এর কারণ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। এ কারণে তা জানা সম্ভব হয়নি।
দায়িত্বশীল সূত্রে মতে, এই বিশাল পরিমাণের অর্থের সুবিধাভোগী পিকে হালদার একা নন। তার আরও সহযোগী রয়েছে। নইলে কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার পরে তিনি দেশ ছাড়লেন কীভাবে। তাদের মতে, এনডিউজ পরিদর্শন করলে সব তথ্য আদায় করা সম্ভব।
বর্তমানে এনডিউজ কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধই রয়েছে। আগে যে হারে এনডিউজ দেখা হতো, এখন তার পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে। ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের সঙ্গে মৌখিক অনুমতি নিয়েই প্রস্তাব পাঠাতে হয় পরিদর্শন কর্মকর্তাদের।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিদ্যমান পরিদর্শন নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। নতুন নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়, ঋণের সদ্ব্যবহার তথ্য পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর পর্যন্ত অবহিত করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ দুষ্কৃতকারীদের নিরাপদ করবে। এই আদেশের ফলে ব্যাংকের সমস্যাগুলো আড়াল থেকে যাবে। এ আদেশের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে দায়িত্ব আছে, তা পালন হবে না। আমি অনুরোধ করব অনতি বিলম্বে আদেশটি তুলে নেওয়ার জন্য।’
পরিদর্শন কার্যক্রম কমিয়ে আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পরিদর্শন কার্যক্রম করা হচ্ছে নিড বেইজড অর্থাৎ প্রয়োজন অনুযায়ী।’
শেয়ারবার্তা/ সাইফুল