ঋণকাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমলেও ব্যাংক খাতে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে আদায় অযোগ্য ঋণ এখন ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়, যাকে অর্থনীতির ভাষায় মন্দ ঋণ বলা হয়, যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। এক বছর আগে এই মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট শ্রেণিকৃত ঋণের ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৮৬ দশমিক ৮০ শতাংশ মন্দ বা ক্ষতিজনক ঋণ।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর হিসেবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ২৬ শতাংশের মতো। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হিসেব ধরে সংস্থাটি যে ধারণা দিয়েছে, তাতে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে আদালতের স্থগিত আদেশে ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে। ৬৭৫ জন শীর্ষ ঋণ গ্রহীতার আবেদনের ভিত্তিতে এই স্থগিত আদেশ দেন আদালত। ফলে ঋণখেলাপির হিসাবটা দেখায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ওই সময়ে (সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে) বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
অবশ্য ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু খেলাপি হিসেবে ঘোষণা করা ঋণ রয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এছাড়া অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ (আগের খেলাপি) রয়েছে আরও প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। আর আদায় করতে না পেরে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে আদালতের স্থগিত আদেশের আরও প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে আদায় অযোগ্য ঋণ।
নাম প্রকাশ না করে বেসরকারি একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংক খাতে বর্তমানে আদায় অযোগ্য ঋণ বা ফেরত পাওয়া যাবে না এমন ঋণ রয়েছে অন্তত ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মতো।’
তার মতে, ঠিকভাবে হিসেব করলে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হবে। কারণ ব্যাংক যখন ঋণের টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়, তখন হয় খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়, নয়তোবা সেই ঋণগুলোকে পুনঃতফসিল করতে হয়। আর পুনঃতফসিল করা ঋণও আদায় অযোগ্য ঋণ হিসেবেই বিবেচিত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ঋণ পুনঃতফসিল হয়, কাজেই পুনঃতফসিল করা অন্যায় নয়।’
তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আগের চেয়ে কমে এসেছে। ব্যাংক খাতে এখন নিট খেলাপি ঋণ ২ শতাংশেরও কম। গত দুই বছরের তুলনায় খেলাপি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে নতুন করে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। আর এই এক বছরে ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে অবলোপন করা হয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণ দেওয়ার আগে ভালো গ্রাহক বাছাই করা উচিত। তা না করে যত্রতত্র ঋণ দেওয়ায় আদায় অযোগ্য ঋণ বাড়ছে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংকগুলো যখন বিতরণ করা ঋণ কোনোভাবেই আদায় করতে পারছে না, তখন সেই ঋণগুলোকে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করছে। এতে কাগজে কলমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর সুযোগ তৈরি হলেও আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘যখন থেকে গুণগত ঋণ বিতরণ বাড়ানো হবে, তখন থেকে আদায়ও বাড়বে।’
প্রসঙ্গত, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গ্রাহক সময়মতো টাকা ফেরত না দিলেও তাকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না। আবার ব্যাংক সেই টাকা ফেরতও পাচ্ছে না। এদিকে পুনঃতফসিল করে গত তিন মাসের ব্যবধানে ২২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে ফেলেছে ব্যাংকগুলো। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজর ২৮৮ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ঋণখেলাপিরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই তাদের ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। আবার কখনও কখনও ঋণের বিপরীতে দেওয়া জামানতের মূল্য বাড়িয়ে তা সমন্বয় করা হচ্ছে।’
এর আগে খেলাপিদের গণছাড় দিতে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের মে মাসে জারি করা ওই সার্কুলারে বলা হয়, ঋণখেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের মেয়াদে মাত্র ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। গণছাড়ের আওতায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছে ব্যাংকগুলো।
শেয়ারবার্তা / মিলন