কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ। বিদায়ী হিসাব বছরে ক্যাটাগরি ধরে রাখার জন্য এক শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। আর্থিক ভিত্তি খুব দুর্বল। তারপরও লাগামহীনভাবে বাড়ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সেন্ট্রাল ফার্মার শেয়ারদর। এর আগেও কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে একটি চক্র নিজেদের ফায়দা হাসিল করেছে। এবারও সেই পথেই হাঁটছে চক্রটি। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এর কিছুই জানে না। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্তৃপক্ষ নিজেরাই অবাক। তারা বলছেন, কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ, তারপরও কেন এভাবে দর বাড়ছে তার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।
কোম্পানির সাম্প্রতিক লেনদেন চিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, ১০ ফেব্রুয়ারি এ কোম্পানির প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয় আট টাকা ৫০ পয়সা। তারপর থেকে কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই এ কোম্পানির শেয়ারদর বাড়তে শুরু করে। সর্বশেষ গতকাল এ শেয়ার ১৬ টাকায় লেনদেন হয়। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে প্রতি শেয়ারের দর বেড়েছে সাত টাকা ৫০ পয়সা বা ৮৮ শতাংশের বেশি।
এদিকে বাজারে গুজব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি একটি বড় গ্রুপ কিনে নিচ্ছে। এই গুজন ছড়িয়ে একটি চক্র ফায়দা হাসিল করার জন্য কারসাজি করছে। সূত্র জানায়, মূলত চারটি মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে এই শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজেই এটা শনাক্ত করতে পারেন। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না।
এদিকে অস্বাভাবিকহারে দর বাড়লেও ডিএসইর বা বিএসইসির পক্ষ থেকে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাধারণত এ ধরনের দর বৃদ্ধি পেলে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু এ কোম্পানির বেলায় (গতকাল) এখন পর্যন্ত কোনো নোটিস প্রদান করা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এ কোম্পানিটিকে অনেক আগেই নোটিস দেওয়া উচিত ছিল। দর বাড়িয়ে ইতোমধ্যে হয়তো কারসাজিকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে চাপিয়ে দিচ্ছে এসব শেয়ার। ফলে শেষ সময়ে নোটিস এলে বিনিয়োগকারীরাই বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন। আর পার পেয়ে যাবেন কারসাজিকারীরা।
অন্যদিকে আলাপকালে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, শুধু এই কোম্পানিই নয়, যে কোনো কোম্পানির শেয়ার অস্বাভাবিকহারে বাড়লে তার কারণ জানতে চাওয়া উচিত। যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা নিশ্চয় বিষয়টি দেখবেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ নভেম্বর সেন্ট্রাল ফার্মা ৩০ জুন ২০১৯ বছরের জন্য মাত্র এক শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। মূলত তারপর থেকেই ওষুধ ও রসায়ন খাতের এই কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়তে শুরু করে। সম্প্রতি যা আরও অস্বাভাবিক হয়েছে। ‘বি’ ক্যাটেগরিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার গত এক বছরে সর্বনি¤œ মূল্য ছিল ছয় টাকা ৬০ পয়সা, সর্বোচ্চ মূল্য হয়েছে ১৬ টাকা ৩০ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের বর্তমান পিই রেশিও ৬৩।
জানতে চাইলে সেন্ট্রাল ফার্মার শেয়ার বিভাগের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি বন্ধ রয়েছে। তারপরও কেন দর বাড়ছে, তা বলতে পারছি না। আমরাও অবাক হচ্ছি। কোনো চক্র এর সঙ্গে জড়িত কি না, তাও বলতে পারছি না আমরা।’ তিনি বলেন, ‘সেন্ট্রাল ফার্মার কয়েকটি ওষুধের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকায় তা পরিবর্তনের নির্দেশ দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সেই কাজের জন্য গত ডিসেম্বর থেকে পুরো কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ছাড়পত্র পেলে আবার আমরা উৎপাদনে যাব।’
এদিকে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মুনাফা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা মুনাফা করেছিল সেন্ট্রাল ফার্মা। ২০১৯ সালে তা নেমে এসে ঠেকেছে পাঁচ কোটি ৭০ লাখ টাকায়। আর ২০১৫ সালে কোম্পানিটি ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল। একইভাবে ২০১৬ সালে ১০ শতাংশ ও ২০১৮ সালে পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। সর্বশেষ গত বছর তা এক শতাংশ নগদে নেমে আসে।
এই প্রতিষ্ঠানের মোট শেয়ারের সংখ্যা ১১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৪৪টি। এর মধ্যে পরিচালকের কাছে আছে ২৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ শেয়ার। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৫৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ শেয়ার।
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। প্রায় ৩৩ বছর পর ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। পুঁজিবাজার থেকে ১৪ কোটি টাকা তোলে সেন্ট্রাল ফার্মা।
এদিকে ৩০ জুন ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে সেন্ট্রাল ফার্মার নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, কোম্পানিটির তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ কোম্পানির ৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার কর বকেয়া আছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানটি নগদে লেনদেন করছে।
নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত সেন্ট্রাল ফার্মার কাছে ৪৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা কর দাবি করেছে এনবিআর। এ বিষয়টিরও কোনো সুরাহা হয়নি।
শেয়ারবার্তা / আনিস