সরকার গত ৫ ফেব্রুয়ারি স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিতে একটি আইন করেছে। এ আইন পাস করা হয়। সরকারের ব্যাংকঋণের ভার অনেক বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের স্বশাসিত সংস্থাগুলোর স্থিতিতে থাকা দুই লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা উন্নয়নের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা থেকে এ আইনটি করা হয়েছে।
আইনটি নিয়ে এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও অনেক অস্বস্তিতে রয়েছে। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করার আগে বিরোধী দলগুলোরও কঠোর আপত্তি ছিল। তারপরও আইনটি কার্যকরে এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আইন পাস হওয়ার ১০ দিনের মাথায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ নিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৬১টি সংস্থায় সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে ওই কমিটি।
সূত্রমতে, আইনটি কার্যকরে ১৬ ফেব্রুয়ারি কমিটি গঠন-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। চার সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা)। আর সদস্য সচিব করা হয়েছে অর্থ বিভাগের নগদ ও প্রচ্ছন্ন দায় ব্যবস্থাপনা অধিশাখার উপসচিবকে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব (বাজেট-১) ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (মনিটরিং সেল)।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের নগদ ও প্রচ্ছন্ন দায় অধিশাখা থেকে জারি করা এ প্রজ্ঞাপনে কমিটির কার্যপরিধিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: আইনের তফসিলে বর্ণিত (৬১) সংস্থার বিগত পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী ও হালনাগাদ ব্যাংক হিসাব বিবরণী এবং সংস্থাগুলোর চলমান ও পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা সংগ্রহপূর্বক বছরভিত্তিক ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা করা। পাশাপাশি ৬১টি সংস্থার পেনশন ও ভবিষ্য তহবিলের হিসাব সংগ্রহ করা। এছাড়া সংস্থাগুলোর তহবিলে উদ্বৃত্ত অর্থের হিসাবসহ সংস্থাভিত্তিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে ওই কমিটি। সংস্থাভিত্তিক এ হিসাব বিবরণী অর্থ সচিবের কাছে উপস্থাপন করা হবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ৬১টি সংস্থার প্রধানের কাছে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় গঠিত ওই কমিটি। এতে বলা হয়েছে, আইনের ৯ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ নিরূপণে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চার ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এগুলো হলো: পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী, নিজস্ব অর্থায়নে চলমান ও আগামী তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা (বছরভিত্তিক সম্ভাব্য ব্যয়সহ), ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সব ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্ট এবং পেনশন ও ভবিষ্য তহবিলে রক্ষিত অর্থের পৃথক হিসাব বিবরণী। ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ তথ্য আবশ্যিকভাবে প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
জানতে চাইলে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ যদি এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে কেউ আর মুনাফা করতে চাইবে না। শুধু নিজস্ব বেতন-ভাতা জোগাড় করেই তারা সন্তুষ্ট থাকবে। আয় বৃদ্ধিতে আর কোনো মনোযোগ দেবে না।
তারা আরও বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত যেসব সংস্থা এরই মধ্যে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে (যেমন: তিতাস গ্যাস, পাওয়ারগ্রীড, পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল প্রভৃতি) তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ নেবে না সরকার। তাহলে বাকিদের অর্থ কেন নেওয়া হবে; এটা তো অযৌক্তিক উদ্যোগ।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন’ গত বছরের সেপ্টেম্বরে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়। আর গত ১৫ জানুয়ারি বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের পর পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল।
বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চালাতে যে খরচ হয় এবং নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরে যে অর্থ লাগে, তা তাদের নিজস্ব তহবিলে জমা রাখা হবে। এছাড়া আপৎকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিচালন ব্যয়ের আরও ২৫ শতাংশ অর্থ এসব সংস্থা সংরক্ষণ করতে পারবে। ওই সংস্থার কর্মীদের পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থও তারা সংরক্ষণ করবে।
পাস হওয়া আইনে ৬১টি সংস্থার তালিকা দেওয়া হয়েছে, যাদের উদ্বৃত্ত অর্থ এখন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আসবে। সেগুলো হলো: জাতীয় কারিকুলাম ও টেক্সটবুক বোর্ড, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, দিনাজপুর উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি-বগুড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক), জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিপিসি), ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি), বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ চা বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসা, ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)।