বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষিতদের প্রায় ৫০ শতাংশই বেকার! আইএলও’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২০ সালে এসে সে সংখ্যা যে আরও বড় হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই আর না বললেও চলে। অন্য এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ এখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার দিক দিয়ে স্বর্ণযুগে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসের সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ জনসংখ্যা কর্মক্ষম; যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা হিসেবে পরিচিত। কোনো দেশে যদি ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম থাকে, তাহলে সে দেশকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা অবস্থায় আছে বলে গণ্য হয়।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মক্ষম. এ ঘটনা এদেশের ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল ঘটনা। সঠিকভাবে কাজে না লাগালে এ সুবিধাজনক অবস্থা অচিরেই পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়িয়ে দেশের দায় হিসেবে আবির্ভূত হবে। দ্রুত ও ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করতে পারলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে অচিরেই বাংলাদেশের সব অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই জাতীয় অর্থনীতির অন্যান্য চালক বা অনুঘটকগুলোর এক বা একাধিক অনুঘটককে ধাক্কা দেওয়া এখন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
এক্ষেত্রে ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স হতে পারে অন্যতম প্রধান মোক্ষম হাতিয়ার। ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স গতিশীল হলে একই সঙ্গে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে সহজেই। শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বিমা খাতে। বিমা খাত ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুস, হবে বিশ্বমানের। বিমা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়বে, একই সঙ্গে বিমা এবং ব্যাংক কোম্পানিগুলোর লাভের পরিমাণ বাড়বে। উভয় খাতে বিদ্যমান জনশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চত করা যাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিমা এবং ব্যাংক সেবা ছড়িয়ে পড়বে। ব্যাংক ও বিমার সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পগুলোর প্রসার ঘটবে। শেয়ারবাজার প্রসারিত হবে। বাড়েব ব্যাপক কর্মসংস্থান।
ভারতে ইতোমধ্যে বিমা পলিসি বিক্রির একটি যুগান্তকারী নতুন ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চালু হওয়ার পর যা ভারতে বিমা পলিসি বিক্রি তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এ খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে ৪৯ শতাংশ। বীমা খাতে দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরোটাই ব্যাংকনির্ভর। কারণ আমরা বিনিয়োগের বিকল্প খাত তৈরি করে একে বহুমাত্রিক রূপ দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। বিনিয়োগের স্বর্ণ সূত্র ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখ না’ ঝুঁকির এ বিষয়টা মাথায় রাখলে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, কতটা ঝুঁকিতে আছে দেশের অর্থনীতি! ব্যাংক খাত একা এত চাপ নিতে পারছে না। ফলে ধেয়ে আসছে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
এটি রোধ করতে, যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশকে পুরো মাত্রায় ব্যাংকনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগের বিকল্প খাত তৈরি করতে হবে। বিনিয়োগের বিকল্প খাত হিসেবে বিমা বিশাল সম্ভাবনাময়। বিমা খাত সমৃদ্ধ হলে ইকুইটি, বন্ড ও ডেরিভেটিভস বাজারের পরিসরও ব্যাপকভাবে বাড়বে। কেননা বিমা কোম্পানিগুলো তাদের আয়ের বড় একটা অংশ বিনিয়োগ করতে হয়। বিদ্যমান জনবল এবং অবকাঠামো দিয়েই ব্যাংকগুলোর বিমা পণ্য বিক্রি করতে পারবে। ফলে তাদের আয় বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখার তালিকার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, এখনও পর্যন্ত ৪৯২টি উপজেলার সব কটিতে সব ব্যাংকের ন্যূনতম একটি করে শাখা নেই। সব ব্যাংকই শহরকেন্দ্রিক; একই অবস্থা ৭৮টি বিমা কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিমা সেবা গ্রামমুখী করে ব্যাংকাস্যুরেন্স দেশকে বিকেন্দ্রীকরণে সহয়তা করবে। যুগপৎভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে ব্যাংক এবং বিমা সেবা। সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশ সমৃদ্ধ হবে।
ব্যাংক এবং বিমা কোম্পনিগুলোর কাজকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে দেখা যায়, এদের কাজের ধরনে কিছু মিল রয়েছে। উভয় খাতই সেবা বিক্রয় করে আয় করে উভয়ে সঞ্চিতি রাখে, অর্থ ব্যবস্থাপনা করে, ঝুঁকি বহন করে, তারল্য রাখতে হয়, বিনিয়োগ করে এবং ‘ল অব লার্জ নাম্বার’ নীতির ওপর ভিত্তি করে লাভ করে। ব্যাংক কম সুদের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলে এবং সেই পুঁজি উদ্যোক্তাদের বেশি সুদে ধার দিয়ে বিনিয়োগে সাহায্য করে এবং আয় করে। অন্যদিকে বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থের (প্রিমিয়ামের) বিনিময়ে মক্কেলের আংশিক বা সব সাম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে। বিমা প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়াম বাবদ যে অর্থ লাভ করে তার একটা বড় অংশ পুনরায় ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্পে বিনিয়োগ করে। ক্ষতি হলে গ্রাহককে বিমা দাবি পরিশোধ করে। বিমা ব্যাংকের ঝুঁকি অনেকাংশে নিজের কাঁধে তুলে নেয়। বিমা ব্যাংক ব্যবস্থার সম্পূরক সেবা বিক্রয় করে একে পরিপূর্ণতা দেয়। ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের মৃত্যু ঝুঁকি, তাদের পণ্যদ্রব্যের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রবিষয়ক সব ঝুঁকিসহ অপরাপর ঝুঁকিগুলো বহন করে বিমা কোম্পানিগুলো। তাই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ব্যক্তি কিংবা সম্পদের ‘বিমা’কে আবশ্যিক করেছে। ফলে তাদের উভয়ের কাজের মাঝে এ ধরনের সমন্বয় সাধন করা গেলে উভয় খাতের অপারেশনাল খরচ কমিয়ে বিষয়টি যে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
অর্থনীতিতে ‘স্কেল অব প্রডাকশনের’ নীতি থেকে আমরা দেখি উৎপাদন বাড়লে পণ্যর উৎপাদন ব্যয় কমে যায়। ফলে আয় বাড়ে। ব্যাংকাস্যুরেন্সে বিমা কোম্পানিগুলো ন্যূনতম খরচে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান শাখা নেটওয়ার্ক এবং জনবল ব্যবহার করে ব্যাপক বিমা পণ্য বিক্রয় করতে সক্ষম হবে। এতে ব্যাংকগুলো যেমন সুদের বাইরে বিশাল অঙ্কের ‘ফি’ আয় করে লাভবান হবে, বিমা কোম্পানিগুলো তেমনি তাদের বিদ্যমান জনবলের সহায়ক শক্তি পেয়ে প্রচুর পণ্য বিক্রয় করে লাভবান হবে। ব্যাংকগুলোর ব্যয় সংকুচিত হওয়ার ফলে তাদের অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমে যাবে। অন্যদিকে বিমা কোম্পানিগুলোর আয় স্ফীত হয়ে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমে যাবে।
নতুন গ্রাহকদেরর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে ব্যাংকের নিজস্ব সেবা বিক্রি বেড়ে যাবে। একইভাবে ব্যাংক তার নিজস্ব গ্রাহকদের কাছে বিমা পণ্যের সুবিধা তুলে ধরার কারণে বিমা পলিসি বিক্রয় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বিমা বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে বিমা খাতের প্রিমিয়াম আয় দশগুণ বৃদ্ধি পাবে। যুক্ত জনশক্তি এবং সমন্বিত সম্ভাবনা নতুন নতুন ব্যাংক এবং বিমা পণ্যর ধারণা তৈরিতে সহায়তা করবে। বিমা কোম্পানির সাবসিডিয়ারি ব্যাংক কোম্পানি কিংবা ব্যাংক কোম্পানির সাবসিডিয়ারি বিমা কোম্পানির জš§ হয়ে অর্থনীতিতে নতুন ধারা তৈরি হবে। তৈরি হবে পুনঃবিমার বিশাল বাজার।
ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স গতিশীল হলে জিডিপিতে নাটকীয়ভাবে বিমা খাতের অবদান অনেক বেড়ে যাবে। প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্স কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র এক শতাংশ বিমা অবদান বৃদ্ধি দুই শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি করে। এর কারণ, এটি ২২ শতাংশ অবিমাজনিত ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগোত্তর কর অবদান হ্রাস ১৩ শতাংশ পর্যন্ত ঠেকিয়ে দিতে সহায়তা করে। বিমা অবদানের গাণিতিক বৃদ্ধি জিডিপি বৃদ্ধিকে জ্যামিতিকভাবে বৃদ্ধি ঘটাবে।
পরিশেষে বলা চলে, বিমা শিল্প কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরিতেই অবদান রাখে না বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকারের আর্থিক চাপ হ্রাস করতেও সহায়তা করে। দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে তাই বিমা প্রিমিয়ামে বিনিয়োগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮০ সালে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হওয়ার পর থেকে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে বিমা পণ্য বিক্রি একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংকাস্যুরেন্স এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশে ব্যাংকাস্যুরেন্স আইন প্রণীত হলে জনগণের সঞ্চয় বাড়বে, বিমা কোম্পানি এবং ব্যাংকের আয় বাড়বে, মূলধন বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে, জনগণের আয় বাড়বে এবং আবারও সঞ্চয় বাড়বে। অর্থাৎ যুগপৎভাবে মোট দেশজ আয়, মোট দেশজ ব্যয় এবং মোট দেশজ সঞ্চয় বাড়বে। পুনঃপুনঃ চলতেই থাকবে; সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হবে দেশ।
নূর–উল–আলম
সহযোগী সদস্য
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ
একটি বেসরকারি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তা
[email protected]
মোবাইল : ০১৬১০-১২৩২২৩