নানা সূচকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে এক সময়ের অভিজাত ব্যাংক এবি ব্যাংক লিমিটেড। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের দিক থেকে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়ে গেছে ব্যাংকটি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা।
গত সেপ্টেম্বর শেষে এবি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু আগের বছরের একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। যা সে সময়ের মোট বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ৭ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে এই খেলাপির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশ।
অভিযোগ রয়েছে, বিশাল অঙ্কের এই খেলাপি ঋণের প্রধান দায় ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কয়েকজন উদ্যোক্তার। ব্যাংকটির উদ্যোক্তারা একদিকে নিজেরা বেনামিতে লুটপাট করেছেন,অন্যদিকে যোগসাজশ করে অসাধু কিছু ব্যবসায়ীকে লুটপাটের সুযোগ দিয়েছেন। তারা শুধু ব্যাংক থেকে ঋণের নামে নেওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতই করেননি, ওই অর্থের প্রায় পুরোটাই বিদেশে পাচার করেছেন।
গত ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা এক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের সব ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে এবি ব্যাংকের পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছেন। তাদের ঋণের স্থিতি ৯০৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা কয়েকজন গ্রাহকও এখন শীর্ষ খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী এমএনএইচ বুলু। তার খেলাপি ঋণ ২৫০ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৮ সালে ভুয়া অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের নামে ১৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক এবং সাবেক দুই এমডি শামীম আহমেদ চৌধুরী ও মো.ফজলুর রহমানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তবে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের পাশাপাশি শীর্ষ এবং মধ্য পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাও ঋণ বিতরণে দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থেকে থাকতে পারেন বলে ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষকদের সন্দেহ। এরা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বড় সুবিধাভোগী হয়ে থাকতে পারেন বলে তাদের ধারণা।বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে,বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রয়োজনীয় সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে এবি ব্যাংক। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নেতিবাচক রেকর্ড। অন্যদিকে ব্যাংকটি প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়ায় মূলধন ঘাটতিও দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ব্যাংকটির বর্তমান মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২২ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
তথ্য মতে,চলতি বছরের জুন শেষে ১ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করেছে এবি ব্যাংক।
এদিকে,চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি মুনাফা কমেছে ৫৪ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের ৯ মাসে এই মুনাফা কমেছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে শূন্য দশমিক ১৯ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল শূন্য ৪১ টাকা। এ হিসাবে ইপিএস কমেছে শূন্য দশমিক ২২ টাকা বা ৫৪ শতাংশ।
সদ্য সমাপ্ত হিসাববছরের (২০১৯) দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকের কোনোটিতেই এবি ব্যাংক শেয়ার প্রতি ৫ পয়সার বেশি আয় করতে পারেনি।
আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই মুনাফায় ধস নামে এই প্রতিষ্ঠানটির। এ বছর প্রতিষ্ঠানটি চার কোটি ছয় লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করে, যা এর আগের আর্থিক বছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ১৫১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। টাকার অঙ্কে মুনাফা কমে ১৪৭ কোটি টাকার বেশি। মুনাফায় বড় ধরনের ধ্বসের কারণে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে যায় এবি ব্যাংক।
বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি,রেকর্ড সঞ্চিতি ঘাটতিসহ বিভিন্ন সূচকের নাজুক অবস্থা সম্পর্কে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানার জন্য নানাভাবে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাকে কয়েক দফা ফোন দেওয়া সত্ত্বেও তিনি রিসিভ করেননি,এসএমএসেরও কোনো উত্তর দেননি।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট অথবা দায়িত্বশীল অন্য কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য জানার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এবি ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান তানিয়া সাত্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এই বিষয়ে কোনো সহযোগিতা না করে প্রথমে প্রতিবেদককে নানা ধরনের প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করেন। এই ধরনের রিপোর্ট না করে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের একটি সাক্ষাতকার প্রকাশ করার জন্য প্ররোচিত করেন। তিনি বলেন,‘পজেটিভ ইন্টারভিউ’ করতে সম্মত হলে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাক্ষাতের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে।
শেয়ারবার্তা/ সাইফুল