পুঁজিবাজারের দুর্দশা কাটাতে সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধি, নতুন বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেওয়া এ উদ্যোগের কারণে বাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থায়ীভাবে এ আস্থা ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দেওয়া পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্য ভালো লক্ষণ। এরই মধ্যে বাজারে তার সুফল দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থাও ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু এ আস্থা ধরে রাখতে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে কিছু দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের কথা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আর্থিক খাতের তথা ব্যাংক খাতের দুরবস্থা দূর করতে হবে। আর্থিক খাতে যদি সমস্যা থাকে তাহলে যে কোনো উদ্যোগ একসময় থমকে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বাজার উন্নয়নে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসা দরকার। পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তারা চিন্তাভাবনা করবে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দরকার। যেমন গ্রামীণফোনের ঝামেলাটি দূর করতে হবে।
অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে আরও কিছু সমস্যা আছে, তাতেও নজর দেওয়া লাগবে। সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টদের দায়বোধ বৃদ্ধি করতে সরকারের পক্ষ থেকে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা দরকার।
খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ
বাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর সাময়িকভাবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটিকে স্থায়ী করা প্রয়োজন। তবে পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা উন্নয়নে শুধু অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি করলেই ফলাফল স্থায়ী হবে না। অন্য ব্যবস্থাও নিতে হবে।
বাজারের মূল সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। শুধু তারল্য সংকটের কারণেই কি আস্থা নেই! মোটেও তা নয়। অর্থ সরবরাহ শেষ হলে বাজার আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। এটি স্থায়ী সমাধান নয়। এজন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে বাজার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর। বর্তমানে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশেষত বিএসইসির (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) প্রতিই আস্থা নেই বিনিয়োগকারীদের। তাই তাদের আস্থা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। যে কোনো সংস্থার নেতৃত্বে নিয়মিত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন পরিবর্তন না আনলে, তাদের ঘিরে বিভিন্ন স্বার্থের জন্ম হয়। স্বার্থের কারণেও অনেক কিছু করা হয় না। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থাভাজন ও পরিচিত নেতৃত্ব আনতে হবে। তাহলে সব উদ্যোগের ফল স্থায়ীভাবে পাবেন বিনিয়োগকারীরা।
আবু আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক অধ্যাপক প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ ভালো হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের কিছুটা আস্থা পূর্বের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থ দেওয়ার ঘোষণায় এটি হয়েছে। কিন্তু এটি সাময়িক, যা একপর্যায়ে থেমে যাবে। শুধু কয়েকটি গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দেওয়া ঠিক নয়। একসময় তারাও অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না।
বাজারের মূল সমস্যা অন্যত্র। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্যেও তা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বাস্তবায়ন করতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদে বাজার ভালো হবে, বাজারের মূল সমস্যা দূর হবে। সেটি হলো, বাজারে সরকারি লাভজনক কোম্পানির শেয়ার আনা। দেশে বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। বর্তমানে ইউনিলিভার, মেটলাইফ ও নেসলের মতো বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। কিন্তু তারা তালিকাভুক্ত নয়। এদের তালিকাভুক্তি করতে হবে।
লন্ডন, আমেরিকা, ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স হার অনেক কম। বাংলাদেশেও তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করপোরেট ট্যাক্স হার কমাতে হবে। না হলে কেউ আগ্রহী হবে না।
শরীফ আনোয়ার হোসেন সভাপতি
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স চার হাজার পয়েন্টে চলে এসেছিল। এই সূচক বিনিয়োগের ইঙ্গিত দেয়। এখন কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কেউ এ বাজারে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেই হোক, সে তার বুদ্ধিমত্তার জোরে বিনিয়োগ পরিকল্পনা করবে। হুজুগে শেয়ার বিক্রি করলে তো লোকসান গুনতেই হবে। এ কারণে বাজারে কিছুটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর আস্থা ফিরে এসেছে। এখানে শুধু অর্থ দেওয়াটা মূল ইস্যু নয়। বিনিয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে যার যা কাজ, তা তাকেই করতে হবে। এখানে জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব, সরকার নীতি সহায়তা দেবে ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করবে। ঘোষণা দিয়ে করার প্রয়োজন নেই, নিয়মিত করলেই হবে। বাজার তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
পুঁজিবাজার নিয়ে এখনও টক শোতে অতিরঞ্জিত কথা হচ্ছে কিছু কিছু বক্তার মাধ্যমে। সূচক পড়লেই মুখরোচক কথা বলছেন অনেকেই বিভিন্ন মহল থেকে। এতে বিভ্রান্তি ছড়ায়, বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি শুরু করেন। তবে আমি আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন, এরপর আর কোনো কথা থাকে না। বাজার ঘুরে দাঁড়াবেই। এখন যে সংস্থার যা কাজ তা নিয়মিত পালন করলেই হয়।
শেয়ারবার্তা / হামিদ