বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ক্রেতারা যে খুব অল্প দামে তৈরি পোশাক কেনেন, সেই বাস্তবতার কথা তুলে ধরে রপ্তানিকারকদের দর কষাকষিতে আরও একটু মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “যদি এই পোশাক কিনতে (বিদেশি ক্রেতারা) এক ডলার করেও দাম বেশি দিত, তাহলে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে আরো উন্নত করা সম্ভব হত।”
বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় বস্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এ কথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “প্রতিযোগিতার ব্যাপার থাকে বলে.. আমি জানি না, আমাদের এই পণ্য যারা রপ্তানি করেন, তারা এই বার্গেনিংটা করেন কিনা। কিন্তু আমার মনে হয় একটু করা উচিত। বায়ারদেরকে বলা উচিত বা ওই দেশগুলোকে বলা উচিত।”
সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি যখন যেখানে যাই, যেসব দেশে আমাদের পোশাক রপ্তানি হয়, সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে যখন কথা হয়, আমি কিন্তু বিষয়টা তুলে ধরি। আমি একা তুলে ধরলে হবে না। আপনারা যারা ব্যবসা করেন, তাদেরও বোধহয় একটু উদ্যোগ নিতে হবে।”
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির অন্যায্য বাণিজ্যের বিষয়টি বিশ্বজুড়েই আলোচিত হয়। বাংলাদেশ থেকে ৫ ডলারে শার্ট কিনে কোনো কোনো কোম্পানি যে দশ গুণ বেশি দামেও তা বিক্রি করছে, সে তথ্যও তখন উঠে আসে।
আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির দিক দিয়ে চীনের পরেই এখন বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাংলাদেশ ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের বেশি।
তবে এই আয়ের একটি বড় অংশ আসে শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-র্শাট, সোয়েটারের মত তুলনামূলকভাবে কম দামি পোশাক থেকে। দামি ও ফ্যাশনেবল পণ্যে লাভ বেশি হলেও এ বাজারে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে৷
প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তাদের নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি পণ্যের বহুমুখীকরণে নজর দেওয়ার তাগিদ দেন শেখ হাসিনা।
“আসলে এক জিনিস সব সময় চলে না। কাজেই রপ্তানির ক্ষেত্রে বহুমুখীকরণ… অর্থাৎ পোশাকের ক্ষেত্রেও তার ডিজাইন, রঙ- সবকিছুই কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। আমি জানি যারা ক্রয় করতে আসে- বায়ার তাদের চাহিদার ওপরই নির্ভর করে। তারপরও আমাদের নিজস্ব একটা উদ্যোগ থাকা উচিত, সেটা হল আমরা নতুন নতুন বাজার- পণ্য বাজার খুঁজে বের করা।”
নতুন কোন বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি করা যায়, কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি, কোন ধরনের পোশাকের চাহিদা বেশি, কোন ধরনের ডিজাইন বেশি চলছে, বছরের কোন সময় কোন রঙ বেশি প্রভাব ফেলে- সেসব বিষয় মাথায় রেখে উৎপাদন বহুমুখী করা প্রয়োজন বলে মত দেন প্রধানমন্ত্রী।
আর সেজন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি আশা করি, আপনারা এই ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন, গ্রহণ করবেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে সব ধরনের সহযোগিতা আমরা করব।”
বাংলাদেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে সরকার আশা করছে।
“এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের এটাই লক্ষ্য, আমাদের দেশীয় পণ্য যা আমরা উৎপাদন করি, সেখান থেকে কী কী কাঁচামাল ব্যবহার করে আমরা পণ্য উৎপাদন করতে পারি এবং বাজারজাত করতে পারি- সেইভাবে আমাদের কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
দেশের ‘সার্বিক উন্নয়ন করাই’ সরকারের লক্ষ্য মন্তব্য করে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ হবে সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত একটি দেশ, উন্নত দেশ, সমৃদ্ধশালী দেশ এবং আমরা তা করতে পারব। এই বিশ্বাস আমার আছে। কাজেই সেই ক্ষেত্রে আমাদের শিল্পায়ন, শিল্প বাণিজ্যের উন্নয়ন এবং সর্বক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি করতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সকলে কাজ করবেন। এটাই আমি আশা করি।”
বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্ব দরবারে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলবে- এমন প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার দেশের সাধারণ নাগরিক কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ- তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। তারাও উন্নত জীবন পাবে। তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে উন্নত জীবনযাপন করবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।”
শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার কথাও উল্লেখ করেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা।
অন্যদের মধ্যে বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
শেয়ারবার্তা / হামিদ