শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আলোচিত শেয়ার বেক্সিমকো লিমিটেড। এই শেয়ারের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর পথে বসার গল্প। বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া ৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ব্য।
২০২০ সালের ১৯ মার্চ শেয়ারটির দাম ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা। যা ওই বছরের শেষ দিকে ২২ টাকায় লেনদেন হয়। তারপর থেকে শুরু হয় শেয়ারটির রেকর্ড কারসাজির গল্প। দুই মাসের মাথায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দাম ওঠে এক’শ টাকায়। এরপর একই বছরের শেষ দিকে দাম তোলা হয় প্রায় তিনগুণ ১৯০ টাকায়। এই সময়ে দেখানো হয় রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা। ঘোষণা করা হয় বড় আকারে ডিভিডেন্ড।
প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক তদন্তে প্রমাণিত হয়, ২০২২ সালের শুরুর দিকে বেক্সিমকোর শেয়ারের দামে কারসাজি করে আট বিনিয়োগকারীর একটি গ্রুপ ৮৪৬ কোটি টাকা রিয়ালাইজড ও আন রিয়েলাইজড গেইন করেছে।
চার ব্যক্তি ও চার প্রতিষ্ঠানের দলটি সক্রিয় লেনদেনের ভুয়া ধারণা সৃষ্টি করতে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে কৃত্রিমভাবে ধারাবাহিক লেনদেনের মাধ্যমে শেয়ারের দাম স্ফীত করেছে, যার বেশিরভাগই হয়েছে নিজেদেরে মধ্যে লেনদেনের মাধ্যমে।
ডিএসই এর তদন্তে শেয়ারটির কারসাজিতে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তারা হলেন, আব্দুর রউফ, ক্রিসেন্ট লিমিটেড, মোসফেকুর রহমান, মমতাজুর রহমান অ্যান্ড দেয়ার অ্যাসোসিয়েটস, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড, মারজানা রহমান ও ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
তদন্ত প্রতিবেদনক অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত বেক্সিমকোর শেয়ারের টার্নওভার মূল্য ছিল ৪৪০৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে ভিন্ন ভিন্ন ক্লায়েন্ট কোডের মাধ্যমে যার ৭০ শতাংশের বেশি লেনদেন করেছে এই আট বিনিয়োগকারী।
তদন্তে দেখা গেছে, গ্রুপটি যৌথভাবে রিয়ালাইজড গেইন করেছে ২১৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং আন রিয়ালাইজড গেইন করেছে ৫২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
২০২২ সালের শেষের দিকে ডিএইর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর কাছে জমা দেওয়া হয়।
এরপর প্রতিবেদনটি শিবললী রুবাইয়াত – উল- ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনে আটকে যায়। কারণ কোম্পানিটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন একটি কোম্পানি এবং কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত কোম্পানিগুলোও তারই মালিকানাধীন। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রিসেন্ট লিমিটেড, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড এবং ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল।
২০২২ সালে জুপিটার বিজনেস এবং ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার অধিগ্রহণের পর এটির বোর্ডে যুক্ত হয়। দুইটি কোম্পানি ফারইস্টের বোর্ডে তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য বেক্সিমকো গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের মনোনীত করে।
ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল বেক্সিমকো গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা জামানুল বাহারকে মনোনীত করে। অন্য দিকে জুপিটার বিজনেস বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা আলী নওয়াজ ও বেক্সিমকো টেক্সটাইলের জেনারেল ম্যানেজার মাসুম মিয়ার নাম সুপারিশ করে।
এরপর বিএসইসি সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের জন্য ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনালকে একটি সতর্কতামূলক চিঠি দেয়। চিঠিতে কোম্পানির ঠিকানা উল্লেখ করা হয় প্যারামাউন্ট হাউজ, ৭ম তলা, পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে। যেখানে বর্তমানে কোম্পানিটির কোন অস্তিত্ব নেই।
এদিকে সিকিউরিটিজ বিধি লঙ্ঘন ও কারসাজির সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ থাকা আব্দুর রউফ নিজেকে বেক্সিমকো গ্রুপের একজন কর্মচারী এবং গ্রুপের ইন্স্যুরেন্স কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করতেন বলে দাবি করেছেন।
শেয়ার কারচুপির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। শুধুমাত্র কোম্পানির লোকেরাই এই বিষয়ে আরো তথ্য দিতে পারবে।
কোম্পানির নামে খোলা বিও হিসাব অনুযায়ী আব্দুর রউফকে ক্রিসেন্ট লিমিটেডের যুগ্ম পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে কিছু নথিতে আমার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, তবে আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’
জুপিটার বিজনেসের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বোর্ডে দায়িত্ব পালন করা আলী নওয়াজ একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘জুপিটার বিজনেস বেক্সিমকোর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান কি না তা আমি জানি না।’
বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে তাকে কেন মনোনীত করা হয়েছে, এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সালমান এফ রহমান আমাকে বলেছিলেন, সরকার বীমা কোম্পানির অবস্থান উন্নত করতে চায়। এর অংশ হিসেবে তিনি আমাকে জুপিটার বিজনেসের প্রতিনিধির ভূমিকার প্রস্তাব দেন। সেই অনুযায়ী আমাকে পরিচালক হিসেবে মনোনীত করা হয়।
বিএসইসি জানিয়েছে বেক্সিমকো শেয়ার ম্যানিপুলেশনের বিষয়টি ২২ আগস্ট ২০২৩ তারিখে শিবলী রুবাইয়াতের কমিশন সভায় উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু কমিশন সভায় তা আলোচনা করা হয়নি।
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেক্সিমকো শেয়ার কারসাজি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯- এর ধারা ১৭ – এর বেশ কয়েকটি উপধারা লঙ্ঘন করেছে। ধারা ১৭ লঙ্ঘন অনুযায়ী এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ।
কারসাজির মাধ্য ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে মুনাফা তুলেছে তাদের মধ্যে মোসফেকুর রহমান, মমতাজুর রহমান অ্যান্ড দেয়ার অ্যাসোসিয়েটসের শেয়ার প্রতি গড় কেনার মূল্য ছিল ১১৩.২৯ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১৫১.৬৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতি শেয়ারে তাদের গড় লাভ ৩৮.৩৮ টাকা। মোসফেকুর রহমানের শেয়ার প্রতি ক্যাপিটাল গেইন ছিল ৫৯.৩১ টাকা। তার শেয়ারের গড় কেনা মূল্য এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল যথাক্রমে ৯১.৪৫ টাকা ও ১৫০.৭৬ টাকা।
আব্দুর রউফের শেয়ার প্রতি গড় কেনা মূল্য ছিল ১২২.২৯ টাকা, এবং তার গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ১৪৮.৮১ টাকা। ফলে তিনি প্রতি শেয়ার ২৬.৫২ টাকা আয় করেছেন। ক্রিসেন্ট লিমিটেডের শেয়ার প্রতি গড় কেনা মূল্য ছিল ১৩০.৬৮ টাকা। শেয়ার প্রতি ১৯.৬৭ টাকা লাভ করে এটি ১৫০.৩৫ টাকায় শেয়ার বিক্রি করেছে।
জুপিটার বিজনেসের রিয়েলাইজড গেইন ছিল শেয়ার প্রতি ২১.৪১ টাকা, যার গড় কেনা মূল্য ১৩২.৩৪ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ১৫৩.৭৫ টাকা।
মারজানা রহমানের শেয়ার প্রতি প্রাপ্ত লাভ ছিল ৩৫.৯৩ টাকা, যার গড় কেনা মূল্য ১১৩.২৫ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১৪৯.১৭ টাকা।
কেনা মূল্য ১৩৪.৩৪ টাকা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১৬০.৬৮ টাকা ধরে ট্রেডেনেক্সটের প্রতি শেয়ারের রিয়েলাইজড গেইন ছিল ২৬.৩৪ টাকা।