চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথমার্ধেই লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ ঋণ নিয়েছে সরকার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ সোয়া লাখ কোটিতে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। যা বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ কমিয়ে আনতে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। বাদ দিতে হবে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো। বিনিয়োগ বাড়াতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবে। নতুবা ভারতের মতো বাংলাদেশের জিডিপিতে ধস নামতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ৪২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যা চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯০ শতাংশ। এই সময় ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। অথচ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়েছিল ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছেই। গত নভেম্বরে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। এটি গত ৭ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আয় কমছে রাজস্ব খাতেও। জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। অথচ এই সময়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
সাধারণত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত নিরুৎসাহী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ এতে ব্যাংকের ঋণযোগ্য তহবিল সরকারের কাছে আটকা পড়ে। ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা চাহিদানুযায়ী ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে ঋণের সুদহারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য অর্থনীতিবিদরা বরাবরই ব্যাংক থেকে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের মুনাফায় ১০ শতাংশ কর আরোপ করায় এই খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারিরা। ফলে এই খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমেছে। এ কারণে ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
গত সেপ্টেম্বরে সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, গত ১০ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১ নম্বরে। এই সময় প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে ১৮৮ শতাংশ।
দেশে ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি কীভাবে, কোথায় থেকে আসে? এমন প্রশ্ন রেখে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, একমাত্র রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ছাড়া আর কোন খাতের সূচক ইতিবাচক ধারায় নেই। রেমিট্যান্সের এই ইতিবাচক ধারাও টেকসই হবে না। কারণ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে ২০১৬-১৭ সালে বিদেশে শ্রমিক বেশি গেলেও বর্তমানে তা কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ভারতের পরিসংখ্যান খুবই শক্ত। সেখানে গবেষকরা বিভিন্ন সূচকের সঠিক পরিসংখ্যান পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ তা পাওয়া যায় না। ভারতে বছরে ৪ বার জিডিপি প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ বছরে একবার (মার্চ মাসে) হিসেব করে বলা হয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ‘এত..’ ( জিডিপির হার) হয়েছে। কিন্তু কীভাবে হয়েছে, তা জানা যায় না। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতা।
আহসান মনসুর বলেন, প্রশ্নটা খুবই সহজ, জিডিপি যদি বাড়ে তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমবে কেন? জিডিপি যদি এতই ভালো হয় তাহলে ভ্যাট আয় কমবে কেন? কারণ ভ্যাট তো জিডিপির সাথে সম্পৃক্ত। যেহেতু ভ্যাট কমছে তাহলে বুঝতে হবে উৎপাদন কমছে। এছাড়া চাহিদা যদি এতই বেশি থাকতো তাহলে আমদানি কমছে কেন? দেশের সিমেন্ট উৎপাদন কমছে কেন? সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা বলেছেন, গতবছর তাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ। কিন্তু এই বছর তা নেতিবাচক হয়ে গেল। এতেই বোঝা যাচ্ছে, বাড়ি-ঘর বা কারখানা নির্মাণ কমে যাচ্ছে।
ভারতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে এটা বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত এমন মন্তব্য করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এজন্য সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। আমদানি, রপ্তানি ও অবকাঠামোখাতসহ অনেক খাত থমকে আছে। ভারতেও এসব খাত থমকে যাওয়ার কারণে জিডিপি কমেছে। এখন এডিপি সংশোধন করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ ব্যয় কমাতে হবে। পুরো ব্যয় করতে গেলে অর্থাৎ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে এই অর্থবছরে সরকারের ঋণ সোয়া লাখ কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। এটা কিন্তু সহজ বিষয় নয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে। কিন্তু সরকারের ব্যয় কমেনি বরং বেড়েছে। এই ব্যয় মেটাতে হলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। এছাড়া সরকারের আর কোনো আয়ের উৎস নেই।
এছাড়া ডলার বিক্রিও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৯৯ মিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছে। ডলার বিক্রি করলে ব্যাংকে টাকা কমে। এ কারণেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে বলে মনে করেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৫ কোটি টাকা।তবে এই ঋণ খুব তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা যায় যদি আয় বাড়ে। কিন্তু রাজস্ব আয়ে তো বাড়ছে না। এছাড়া সরকারের আর কোন আয়ের খাত নেই।
ঋণ কমিয়ে আনতে এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় কি জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন এডিপিতে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অনেক ছোট ছোট প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। যেহেতু বড় প্রকল্পে বন্ধ করা যাবে না। তাই অপ্রয়োজনীয় এবং প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলোতে সংশোধনী এনে সেগুলোর আকার ছোট করতে হবে। এতে সরকারের ব্যয় কমবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমদানি, রপ্তানি ও রাজস্ব আয় কমছে। কিন্তু সরকার যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যাংক থেকে ধার নিচ্ছে। তবে ব্যয় কমাতে এখন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে আগে থেকেই তারল্য সংকট রয়েছে। বেসরকারি খাতেও ব্যাংক খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কম ছিল। এখন সরকারের ঋণের কারণে এই প্রবৃদ্ধি আরো কমে যেতে পারে।
শেয়ারবার্তা / হামিদ