ভুয়া এনআইডি দিয়ে দ্রিনান নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। ওয়াকামা লি:, পি অ্যান্ড এল, কণিকা, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল, দেয়া শিপিং, আরবি, বর্ণ, নিউট্রিক্যাল, মুন, আর্থস্কোপ, এমটিবি মেরিনসহ দুই ডজন কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়ে পি,কে হালদার ও তার সহযোগীরা চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করেছেন প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা।
কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পলাতক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার জালিয়াতিতে ব্যবহার করেছেন জাল এনআইডি। একই ঠিকানায় নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের রেজিষ্ট্রেশন করেছেন। অন্তত, ১৪টি প্রতিষ্ঠানের রেজিষ্ট্রেশন দুটিমাত্র ঠিকানায় করার প্রমাণ পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল। ভূয়া ঠিকানায় করা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে, ঋণ নিয়ে সেগুলো পাচার করেছেন হালদার।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে সুনির্দিষ্ট এসব তথ্য উঠে এসেছে। পিকে হালদারের জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধান করছে দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি দল।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্র বলছে, রিলায়েন্স লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকার সময় পিকে হালদার জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ইরফান আহমেদ খান এবং ভার্স মেটাল ইন্ড্রাস্ট্রিজের মালিক ফয়সাল মুস্তাকের নামে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেন। বাস্তবে এ দুই নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভুয়া এনআইডি তৈরি করে তাদের নামে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এনআইডি ও ট্রেড লাইসেন্স এর ঠিকানাগুলোও ভূয়া।
জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেও প্রায় ২০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণের নামে তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
একই প্রতিষ্ঠানকে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ১০০ কোটির টাকার মতো ঋণ দেওয়া হয়েছে।
তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এঁদের নামে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ঋণের নামে তুলে আত্মসাৎ করেন হালদার। অনুসন্ধানে দুদক প্রমাণ পেয়েছে-এই জালিয়াতিতে পিকে হালদারের সহযোগী ছিলেন; তার ঘনিষ্ট বন্ধু চট্রগ্রামের ঋণ-খেলাপী ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম চৌধুরী। আলিম চৌধুরী কক্সবাজারের রেডিসন ব্লু হোটেলের একক মালিক ছিলেন। পরে হোটেলটি পিকে হালদারের কাছে ৮৪ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, আব্দুল আলিম চৌধুরী নিজের জন্য পিকে হালদারের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ঋণ অনুমোদন করিয়ে নেন। বিনিময়ে তিনি হালদারকে বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতি ও বিদেশে অর্থ-পাচারে সহায়তা করেন। আব্দুল আলিম চৌধুরী নিজেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন মর্মে দুদকের কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে।
অনুসন্ধানের তথ্যমতে, মন্টিনিগ্রোতে ৬০০ কোটি টাকা খরচ করে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ করেন আলিম চৌধুরী, যাতে পিকে হালদারেরও অংশীদারিত্ব আছে।
অনুসন্ধান আরও বলছে, জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে চট্রগ্রামের ওয়ান ব্যাংকের জুবিলী রোড ও স্টেশন রোড শাখায় একাধিক ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছিল। একইভাবে, বিডি ট্রেডিং নামক অস্তিত্ববিহীন আরেকটি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়- যার মালিক ইরফান। এ দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে বিদেশে পাচার হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
একই কায়দায় ভুয়া এনআইডি দিয়ে দ্রিনান নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। ওয়াকামা লি:, পি অ্যান্ড এল, কণিকা, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল, দেয়া শিপিং, আরবি, বর্ণ, নিউট্রিক্যাল, মুন, আর্থস্কোপ,এমটিবি মেরিনসহ দুই ডজন কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়ে পি,কে হালদার ও তার সহযোগীরা চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করেছেন প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা।
উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান দলটি দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে জালিয়াতির ঘটনায় প্রথম পর্যায়ে গত ২৫ জানুয়ারি হালদারসহ ৩১জনকে আসামি করে ৫টি মামলা করে দুদক। এর ধারাবাহিকতায় আরও মামলা আসছে বলে জানিয়েছে কমিশন সূত্র।
ওইসব মামলায় পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও আইএলএফএসএল এর সাবেক এমডি রাশেদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত রাশেদুল আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হালদারের জালিয়াতির নানা কৌশলের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জালিয়াতির তথ্য চেপে রাখতে হালদার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন ডেপুটি গভর্নর ও সাবেক একজন জিএমকে (বর্তমানে নির্বহী পরিচালক) আর্থিক সুবিধা দিতেন নিয়মিত। তাঁদের মাধ্যমেই সব অপকর্মের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ-পর্যায়ের নজর এড়াতেন।
এর আগে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে দুদক যে মামলাটি করে তার তদন্ত করছেন উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। ওই মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে হালদারের ঘনিষ্ট সহযোগী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা, অসীম কুমার মিস্ত্রি, অবন্তিকা বড়াল ও শংখ ব্যাপারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সুকুমার মৃধা, তাপসী রানী শিকদার, অসীম কুমার মিস্ত্রি, স্বপন কুমার মিস্ত্রি ও অনিন্দিতা মৃধার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
বিদেশে থাকা পিকে হালদার গত ২৮ জুন আইএলএফএসএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে তার দেশে ফেরার জন্য ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন।
আদালত তাতে অনুমতি দিলেও পিকে হালদার না ফেরায়, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।