দেশের পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দিতে বিভিন্ন সময় ইনভেস্টমন্টে কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) অর্থ দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন ইক্যুইটি মাইনাসে। পচাঁ শেয়ারের ভাগাড়ে পরিণত হওয়া প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেওয়াতো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এখন অন্যের সাপোর্ট দরকার।
পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেওয়া আইসিবির অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও তা সঠিকভাবে পালন করা হয়নি। কোন ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যতসব পচাঁ শেয়ার কেনা হয়েছে। যার ফলে প্রত্যাশিতভাবেই সেসব শেয়ার দর এখন তলানিতে। এটি আরও ভয়াবহ হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির কারনে। এতে করে আইসিবির পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের দর ক্রয় মূল্যের থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা নিচে নেমে এসেছে। যাতে আইসিবির ইক্যুইটি মাইনাস হয়ে গেছে।
জানা গেছে,আইসিবি যে কত দুরাবস্থার মধ্যে রয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেনের এক বক্তব্যে উঠে আসে। গত ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেন, ২০১০ সালের ধস শুরুর পর থেকেই আইসিবি বিনিয়োগ করে করে আসছে। নিজের ব্যবসার কথা চিন্তা না করে শুধুমাত্র পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বিনিয়োগ করেছে। তবে ২০২০ সালে এসে আইসিবি বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আইসিবির বিরুদ্ধে দুর্বল ও বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কেনার অভিযোগ শুনে আসছি। এছাড়া গেম্বলারদের স্বার্থে উচ্চ দরে নতুন শেয়ার কিনে পার্কিং করার অভিযোগও আছে। এ অভিযোগ থেকে বিগত কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করা আইসিবির কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালকই (এমডি) বের হতে পারেননি। এই বিষয়টি স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে পরিস্কার করার জন্য তদন্ত করা উচিত।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের ৩১ মার্চ আইসিবির নিজস্ব বা পৃথক হিসাবে বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের দাম ক্রয় মূল্যের থেকে ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ৭১ লাখ নিচে নেমে এসেছে। যার জন্য রিজার্ভ রাখতে গিয়ে কোম্পানিটির ইক্যুইটি ২৪৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। এরফলে ৭৬৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ (এনএভিপিএস) ঋণাত্মক হয়েছে ৩.২৪ টাকা।
এছাড়া কোম্পানিটির ২০১৯ সালের ৩০ জুন বিনিয়োগকৃত শেয়ারের বাজার দর ছিল ১১ হাজার ৬০৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। এরপরে বিগত ৯ মাসে বিক্রির চেয়ে বেশি কেনা সত্ত্বেও ৩১ মার্চ সিকিউরিটিজের বাজার দর নেমে এসেছে ৮ হাজার ৮৬৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এ কোম্পানিটি থেকে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের বাহিরে সবচেয়ে বেশি (অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানি) বিনিয়োগ করা হয়েছে বিতর্কিত পদ্মা ব্যাংকে। এই ব্যাংকে বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে সাবসিডিয়ারিসহ সমন্বিত হিসাবে আইসিবির ইক্যুইটি কিছুটা পজিটিভ রয়েছে। কোম্পানিটির সাবসিডিয়ারিসহ কেনা সিকিউরিটিজের দর ক্রয় মূল্যের থেকে ৪ হাজার ৫৬ কোটি ২ লাখ টাকা নিচে অবস্থান করছে। এর মাধ্যমে গত বছরের ৩০ জুনের ৩ হাজার ১০৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকার ইক্যুইটি ২০০ কোটি ২৬ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। এরফলে ৪০.৫২ টাকার এনএভিপিএস ২.৬১ টাকায় নেমে গেছে।
কোম্পানিটি পচাঁ শেয়ার আটকে রেখে ইক্যুইটি মাইনাস করে ফেলেছে। অন্যদিকে আইসিবি তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের কথা বিবেচনায় ভালো শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে মুনাফা করে শেয়ারহোল্ডারদের বিতরন করছে। এভাবে ভালো শেয়ারগুলো বিক্রি ও পচাঁ শেয়ার পার্কিং করতে করতে কতদিন টিকে থাকতে পারবে, তা এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়িঁয়েছে।
উক্ত বিষয়ে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, ওইসব শেয়ারগুলো অনেক আগে থেকেই ছিল। যখন নেওয়া হয়েছিল ঠিক ছিল, এখন সব একাকার হয়ে গেছে। তবে এ বিষয়টি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে পারি না এবং সুযোগ হয় না। এ নিয়ে কিছু সমস্যাও আছে।
তাছাড়া সমন্বিত হিসাব অনুযায়ি, আইসিবি ৯ মাসের ব্যবসায় (জুলাই ১৯-মার্চ ২০) ৯৩৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। এ থেকে ক্যাপিটাল গেইন হয়েছে ৩৬৫ কোটি ০৩ লাখ টাকা। একইসময়ে কোম্পানিটি ১ হাজার ৪৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার সিকিউরিটিজ ক্রয় করেছে।
আইসিবিকে বিদ্যমান দুরাবস্থা থেকে বের কর আনতে এবং পুঁজিবাজারে সঠিক দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারের জন্য এরইমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের খোঁজে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
যারা আইসিবির বর্তমান ও ঐতিহাসিক আর্থিক এবং অ-আর্থিক পারফরম্যান্স, সার্বিক কার্যক্রম, পুঁজিবাজার উন্নয়নে আইসিবির ভূমিকার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিবি যথাযথভাবে তার দায়দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেটি পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।
এছাড়া আইসিবির প্রকৃত ব্যবসায়িক সুযোগ খুঁজে বের করা, বিনিয়োগ কৌশল, পোর্টফোলিওর ঝুঁকি বিশ্লেষণ, পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যকরণ, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, তহবিলের উৎস ও ব্যবহার এবং আইসিবি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পর্যালোচনা করবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।