করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৫ দফা প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে টাকার প্রবাহ ও ঋণ বিতরণের ক্ষমতা বাড়ানো হবে। কেননা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৫ প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকগুলোকে বেশি মাত্রায় ঋণ বিতরণ করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মেটাতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, করোনার প্রভাব মোকাবেলার জন্য সরকার যেসব প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেগুলো ব্যাংকিং খাতনির্ভর। এর বাইরেও কেন্দ্রীয ব্যাংক থেকে নানাভাবে দেশের বাণিজ্য ও উৎপাদন খাতকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে বহুমুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার জোগান, সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার বিপরীতে আটকে থাকা অর্থ ছাড়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনে অর্থের জোগান, বৈদেশিক উৎস থেকে ব্যাংকগুলোর অর্থ সংগ্রহের বিধি শিথিল করা, বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিক্রি করে নগদ অর্থ নিতে পারবে। এছাড়াও এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে আমানত বা ধার নেয়া, বিধিবদ্ধ আমানত (এসএলআর) হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা অর্থ কিছুটা ছাড় করতে এর হার কমানো, সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। এর বাইরে ব্যাংকগুলো তাদের শেয়ার বিক্রি করেও অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্যাকেজটি পুরোপুরি ব্যাংকনির্ভর হয়ে গেছে। এতে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়বে। এটি বাস্তবায়ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তা না হলে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে উৎসাহিত হবে না।
সূত্র জানায়, করোনার প্রভাবে গত প্রায় এক মাস ধরে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। আমদানি করায় ইতোমধ্যে দেশে শিল্পের কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে রফতানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স কমার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমেছে। আগের এলসির দেনা এখন শোধ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়েছে। ব্যাংকে এখন চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার জোগান না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, করোনার প্রভাব কমায় চীনের অবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ফলে চীন থেকে পণ্য আমদানির এলসি খোলার হার বেড়েছে। একই সঙ্গে করোনার প্রভাব খুব বেশি নেই এমন সব দেশ থেকেও পণ্য আমদানির এলসি খোলার প্রবণতা বেড়েছে। এদিকে প্যাকেজ অনুযায়ী ঋণ বিতরণ শুরু হলে তখন আমদানির প্রবণতা আরও বাড়বে। তখন বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদাও বাড়বে। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ২৫৭ কোটি ডলার, যা দিয়ে প্রায় ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। রিজার্ভের নিরাপদ মান অনুযায়ী কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকলেই হয়। ফলে বাড়তি রিজার্ভ থেকে আমদানির চাহিদা মেটানো হবে। ইতোমধ্যে রফতানিকারকদের চাহিদা মেটাতে রফতানি উন্নয়ন তহবিলের আকার ১৫০ কোটি ডলার বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এ অর্থ জোগান দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকগুলো তাদের অর্থ সরকারি খাতের বিভিন্ন ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে। সেগুলো থেকে সরকারকে ঋণের জোগান দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করলে ওইসব বিল ফেরত দিয়ে তারা টাকা নিতে পারবে। এসব বিল ও বন্ড শেয়ারবাজারেও বেচাকেনা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো মনে করলে সেখান থেকেও এগুলো বিক্রি করে টাকা নিতে পারবে। ক্রেতা না থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো কিনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টাকার জোগান দেবে। সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে এসব বিল ও বন্ড বেচাকেনা হয় না বললেই চলে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই এগুলো কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে বিধিবদ্ধ আমানত হিসাবে ১৩ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে হয়। এর মধ্যে নগদ রাখতে হতো সাড়ে ৫ শতাংশ। সেটি কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত জোগান এসেছে। এই হারে আরও ছাড় দিয়ে বাজারে টাকার জোগান বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো নষ্ট অ্যাকাউন্টে (বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রায় খোলা হিসাব) জমা থাকা ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে বিক্রি করে টাকা নিতে পারবে। ব্যাংকগুলো যাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ বা আমানত নিতে পারে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা জারি করেছে। বিশেষ করে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় এগুলো সংগ্রহ করতে পারে। এক্ষেত্রে বিধি শিথিল করা হবে।
এর বাইরে ব্যাংকগুলো জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ নিতে পারবে। এরপরও তাদের অর্থের প্রয়োজন হলে শেয়ার বিক্রি করেও অর্থ নিতে পারবে। এসব পদক্ষেপের ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়বে। ফলে প্যাকেজের আওতায় বাড়তি ঋণের জোগান দিতে টাকার সংকট হবে না বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে অনেক ব্যাংক ইতোমধ্যে ঋণ সীমা অতিক্রম করেছে। যে কারণে ওইসব ব্যাংক ঋণ দিতে পারে না। বর্তমানে সাধারণ ব্যাংক তাদের মোট আমানতের ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ ঋণ দিতে পারে। এই সীমা আরও বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে বড় অংকের ঋণ সীমাও বাড়ানো হবে। ফলে ব্যাংকগুলো বাড়তি ঋণ বিতরণ করতে পারবে।
গত রোববার প্রধানমন্ত্রী ৫টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে দুটি প্যাকেজের আওতায় ৫০ কোটি টাকার ঋণ দেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আরও দুটি প্যাকেজের আওতায় ১৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ও ৫ হাজার কোটি টাকা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাকি একটি প্যাকেজের আওতায় বাজেট থেকে দেয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। অন্য একটি প্যাকেজের আওতায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হবে। এতে অর্থের জোগান দেবে সরকার।
অর্থাৎ ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেবে ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে ১৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা দেবে। বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে সরকার। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে কোনো বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
শেয়ারবার্তা / হামিদ