বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এক-তৃতীয়াংশ শেয়ারের মালিকানাই শীর্ষ তিন শেয়ারহোল্ডারের দখলে রয়েছে। আর এ শীর্ষ শেয়ারহোল্ডারের অধিকাংশই একই পরিবারের সদস্য। তাছাড়া যেসব কোম্পানিতে উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বেশি, সেসব কোম্পানি স্বতন্ত্র পরিচালকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রায়ই হস্তক্ষেপ করে থাকে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়ে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘পোর্ট্রেট অব বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টরস’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত ২৯৪টি কোম্পানি এবং ৬১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালকের তথ্য পর্যালোচনা করেছে আইএফসি। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ৩০ জুন সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
আইএফসির প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মালিকানা কাঠামো পরিবারের সদস্য কিংবা সাধারণ ব্যক্তিশ্রেণীর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কিংবা অন্য কোম্পানির অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। দেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের ৩২ দশমিক ৩৩ শতাংশই রয়েছে শীর্ষ তিন শেয়ারহোল্ডারদের কাছে। শীর্ষ পাঁচ শেয়ারহোল্ডারের কাছে রয়েছে ৩৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ শেয়ার আর শীর্ষ ১০ শেয়ারহোল্ডারের কাছে ৪১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। আইএফসির গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে উদ্যোক্তাদের মালিকানার আধিক্য রয়েছে, সেসব কোম্পানিতে সাধারণত নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে কিংবা এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়, যিনি মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবেন।
আইএফসির পর্যালোচনায় দেখা যায়, খাতভেদে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পর্ষদের আকার ৬ থেকে ১৭ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পর্ষদের গড় সদস্য সংখ্যা ৯। আর মোট পর্ষদ সদস্যদের ২৪ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক। বছরে গড়ে প্রায় ১০টি পর্ষদ সভা হয়ে থাকে এবং এসব সভায় স্বতন্ত্র পরিচালকদের অংশগ্রহণের হার ৭৬ শতাংশ। অন্যদিকে বছরে গড়ে প্রায় পাঁচটি নিরীক্ষা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের অংশগ্রহণের হার ৯৩ শতাংশ।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বতন্ত্র পরিচালকদের ৬৮ শতাংশই নিরীক্ষা কমিটির সদস্য। আর স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ নারী রয়েছেন। তবে সার্বিকভাবে কোম্পানির পর্ষদে নারী সদস্যের সংখ্যা ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বতন্ত্র পরিচালকদের গড় বয়স ৬৪ বছর, যা এশিয়া ও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মাত্র ৪ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালকের বয়স ৪৫-এর কম।
আইএফসি মনে করে, বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা অসাধারণ। ৫৮ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তরসহ গড়ে ৩৭ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ৯ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালকের পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে। তবে স্বতন্ত্র পরিচালকরা যোগ্যতা ও দায়িত্ব অনুসারে সমানুপাতে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না বলে আইএফসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সব খাত মিলিয়ে দেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বতন্ত্র পরিচালকরা গড়ে বছরে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৮ টাকা বা ১ হাজার ৭৫৯ ডলার পারিশ্রমিক পান। যেখানে ভারতে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক বছরে গড়ে ১০ হাজার ৬৫৬ ডলার পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের গড় মেয়াদ ২ দশমিক ৪ বছর। ৯৯ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালকই ছয় বছরের চেয়ে কম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাছাড়া প্রায় সব স্বতন্ত্র পরিচালকই একটিমাত্র তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন। মাত্র ৪ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালকের দুই বা ততোধিক কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ন্যাশনাল পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ আইএফসির গবেষণার বিষয়ে বলেন, আমাদের এখানে সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে কোম্পানিতে মালিকপক্ষের অংশগ্রহণ বেশি থাকলে তারা প্রভাব খাটাতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এবং বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে মালিকদের অংশ অনেক কম থাকে। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও পেশাদারদের আধিক্য বেশি থাকে। স্বতন্ত্র পরিচালকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করার বিষয়টি যেমন ঠিক, একইভাবে স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্যে কোম্পানির মালিকপক্ষের অনুরোধ গ্রাহ্য না করার প্রবণতাও কিন্তু বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বতন্ত্র পরিচালকের ভূমিকা ও গুরুত্ব আরো বাড়বে। একইভাবে স্বতন্ত্র পরিচালক ও পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণও দেশে ও করপোরেট খাতের অগ্রগতির সঙ্গে সমানুপাতে বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
শেয়ারবার্তা / আনিস