আর্থিক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিং বন্ধ না করার প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠনের জন্য বেশ কয়েকটি শিল্পগ্রুপ আলোচনা করেছে। বিভিন্ন শর্তে তাদের সঙ্গে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংরেক দরকষাকষি চলছে। প্রতিষ্ঠানটি চালু করার একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, পিপলস লিজিং পুনর্গঠনের জন্য ইতোমধ্যে তিনটি গ্রুপ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে শামসুল আলামিন গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ ও বেক্সিমকো গ্রুপ। এসব গ্রুপ থেকে আটজন পরিচালকসহ মোট নয়জন পরিচালক করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো ও বসুন্ধরা গ্রুপের দুজন করে মোট চারজন এবং শামসুল আলামিন গ্রুপের চারজন ও আমানতকারীদের মধ্য থেকে একজন রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, পিপলস লিজিংয়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের চেয়ে বড় বিষয় আদালত কী রায় দেন। কারণ অবসায়নের বিষয়টি আদালতে প্রক্রিয়াধীন। পিপলস লিজিংয়ের যে অবজার্ভার নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার কাছে আদালত প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা জানতে চেয়েছেন। এটি ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে। আদালত এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
এদিকে পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য গত বছরের ১৪ জুলাই আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিনই মামলার শুনানি শেষে প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে পিপলস লিজিংয়ের নামে থাকা সব হিসাব ও অনিয়মের দায়ে বহিষ্কৃত নয় পরিচালকের নামে থাকা শেয়ার ও তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়।
এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজনকে অবসায়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবসায়ক নিয়োগের আদেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান খানকে অবসায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
পিপলস লিজিং অবসায়নের থবরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন আমানতকারীরা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তি নয়, অনেক প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীও অর্থ তুলে নিচ্ছে। এতে অনেকটা চাপে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন পরিস্থিতিতে গত ৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠকে বসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএলএফসিএ)।
বৈঠকে লুটপাট আর নানা অব্যবস্থাপনায় সংকটে পড়া ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) পুনঃসংস্কারের করার কথা বলা হয়। এটি কীভাবে করা যায় এ বিষয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নীতিনির্ধারণ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন দিতে এনবিএফআইয়ের নেতাদের বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও কাজ করছে বলে বৈঠকে জানানো হয়।
এর আগে ২ মার্চ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিদের প্রতিনিধিরা। তাদের চলমান দুরবস্থা কাটাতে ১০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল, নগদ জমা সংরক্ষণ সিআরআর এবং এসএলআরের অনুপাত পরিবর্তন, এনবিএফআইগুলোতে থাকা তফসিলি ব্যাংকের আমানত আগামী দুই বছর প্রত্যাহার না করা এবং সুদের সর্বোচ্চ হার সাত শতাংশ বেঁধে দেয়ারসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানান বিএলএফসিএ।
এ বিষয়ে বিএলএফসির চেয়ারম্যান ও আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম জানান, ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টির মতো প্রতিষ্ঠান খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে পুরো সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই সংকটে থাকা এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনঃসংস্কার করা হবে। এটি কীভাবে করা যায় এ বিষয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নীতিনির্ধারণ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে পিপলস লিজিং পুনর্গঠনের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক দায়িত্বে থাকা শামসুল আলামিন গ্রুপ। এ বিষয়ে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জাগো নিউজকে বলেন, পিপলস লিজিং পুনর্গঠনের জন্য আমরা আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। এখনও আলোচনা চলছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
পুনর্গঠনে কোন কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি থাকছে জানতে চাইলে আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, যেহেতু আলোচনা চলছে এখনও চূড়ান্ত হয়নি তাই কানো নাম বলা ঠিক হবে না।
এদিকে প্রস্তাবিত নয় পরিচালকের মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারী কাউন্সিলের আহ্বায়ক মো. আনোয়ারুল হকও রয়েছেন। পিপলস লিজিংয়ে তার প্রায় ৩৮ কোটি টাকা আমানত রয়েছে। তিনি হারপুন সিকিউরিটিজের মালিকানায় রয়েছেন।
আনোয়ারুল হক বলেন, প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠন করার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু শর্ত দিয়েছে। এগুলো কীভাবে পরিপালন করা যায় তার হিসাব-নিকাশ চলছে। তবে খুব শিগগিরই এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত আসবে।
সম্প্রতি এক মানববন্ধনে পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা তিনটি দাবি জানান। সেগুলো হলো- ছয় হাজার আমানতকারীর টাকা দ্রুত ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা, পিপলস লিজিংকে সরাসরি অবসায়ন না করে ফারমার্স ব্যাংকের মতো পুনর্গঠনের আহ্বান ও অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
শেয়ারবার্তা / আনিস