বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এখন পর্যন্ত ১৫১ টি দেশি-বিদেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুখবর দিচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো।
উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হোন্ডা মটরস, সুমিটোমো, নিপ্পন, এশিয়ান পেইন্টস ও বার্জার পেইন্টস, আদানি, উইলমার, ইয়াবাং, জিনদুন, সিয়াম গ্রুপ, টিআইসি গ্রুপ, ইউনিলিভার, সাকাতা ইনক্স ও চায়না হারবার অন্যতম।
প্রস্তাবিত প্রায় ৪শ ৮০ কোটি ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগের মধ্যে প্রায় ৫৫ কোটি ডলার ইতোমধ্যে বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগকারী দেশের মধ্যে জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও নেদারল্যান্ড উল্লেখযোগ্য।
অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, এই বিনিয়োগ প্রস্তাবের বাইরেও অনেক বিশ্বখ্যাত বিদেশি প্রতিষ্ঠান বড় বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে তাদের এই আগ্রহ বাংলাদেশের অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। পরিকল্পিত শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানি বাড়ানো ও বহুমুখীকরণে উৎসাহ দেয়ার লক্ষ্যে বেজা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
তিনি জানান, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার উম্মোচন করতে বেজা ইতোমধ্যে ৮টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে শিল্প স্থাপনের উপযুক্ত করেছে। এগুলো হলো; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের আওতাধীন মীরসরাই-২এ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মীরসরাই-২বি অর্থনৈতিক অঞ্চল, মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং এসবিজি অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল।
পবন চৌধুরী উল্লেখ করেন, দেশ-বিদেশের অনেক উদ্যোক্তা অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন তাদের শিল্প ইউনিটের নির্মাণকাজ শুরু করেছেন।
তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিজিএমইএ গার্মেন্টস পার্ক ও পিপিপি জোন এবং ৫৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৭৭ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২শ ৫৯ কোটি ডলার এবং সম্ভাব্য কর্মসংস্থান (বিজিএমইএ গার্মেন্টস পার্ক, বেপজা ও এসবিজি ইকোনমিক জোনসহ) প্রায় ৭ লাখ।
চীনা জুজু জিনয়ুয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি লিমিটেড-এর একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জিনয়ুয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার মীরসরাই, সীতাকুন্ডু ও সোনাগাজী উপজেলায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে কারখানা স্থাপন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে এ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ২০ টি প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা নির্মাণ কাজ শুরু করবে।
বেজার নির্বাহী প্রধান আরও উল্লেখ করেন, বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার জন্য আরও ৭টি রাষ্ট্রায়ত্ব বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বেজা সারাদেশে আরও ১৪টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা করছে এবং এর মধ্যে নেত্রকোনা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বগুড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
অন্য ১২ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো: গোপালগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল-১, সীতাকুন্ড অর্থনৈতিক অঞ্চল, টাঙ্গাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল, মানিকগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ভোলা অর্থনৈতিক অঞ্চল, নবাবগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিলেট বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, চাঁদপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল-২, নীলফামারী অর্থনৈতিক অঞ্চল, আড়াইহাজার অর্থনৈতিক অঞ্চল-২ এবং পঞ্চগড় অর্থনৈতিক অঞ্চল।
পবন চৌধুরী জানান, জিটুজি ভিত্তিতে জাপান, চীন ও ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া সিংগাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও সৌদি আরবের সাথে জিটুজি ভিত্তিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা চলছে।
আগামী ৫০ বছরে যাতে ভূমি অপ্রতুলতার কারণে শিল্প বিকাশ বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য বেজা ভূমি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। বেজা নির্বাচিত ৮৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ইতোমধ্যে ২২টি সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের জন্য মোট ৪৭ হাজার ৮৫৬.৩৩৫০ একর জমি বন্দোবস্ত অথবা অধিগ্রহণ করেছে। তার মধ্যে ৬ হাজার ৮৮০.১৮৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ ও ৪০ হাজার ৯৭৬.১৪৮৫ একর জমি বন্দোবস্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
বেজা ইতিমধ্যে ২০ টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রাক-যোগ্যতার লাইসেন্স দিয়েছে এবং যার মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চল, আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল, আমান অর্থনৈতিক অঞ্চল, বে-অর্থনৈতিক অঞ্চল, মেঘনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কর্ণফুলী ড্রাই ডক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইস্ট ওয়েস্ট বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কিশোরগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হোসেন্ডি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে বেজা চূড়ান্ত লাইসেন্স দিয়েছে।
অন্যদিকে একে খান অর্থনৈতিক অঞ্চল, আরিশা অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইউনাইটেড সিটি আইটি পার্ক, বসুন্ধরা অর্থনৈতিক অঞ্চল, সোনারগাঁও অর্থনৈতিক অঞ্চল, কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চল, হামিদ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং স্ট্যান্ডার্ড গ্লোবাল অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রাক-যোগ্যতা সনদ পেয়েছে।
বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং দেশের এক কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন-২০১০ এর আওতায় বেজা প্রতিষ্ঠিত হয়।
অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ফলে, ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে এবং প্রস্তাবিত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যেমে কমপক্ষে ৮ লাখ লোকের সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে ‘ফেমোজা অ্যাওয়ার্ড ২০১৯’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। গত বছর ১৪ নভেম্বর ইউরোপের মোনাকোতে এক সম্মেলনের মাধ্যমে এ পুরষ্কার বেজার হাতে তুলে দেয়া হয়।
শেয়ারবার্তা / মিলন