পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের অবসায়ন না করে পুনর্গঠন অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তি আমানতকারীদের সঞ্চয় ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছেন আমানতকারীরা।
রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে “পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিতে আমানতকারীদের কাউন্সিল” ব্যানারে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংবাদ সম্মেলনে তিনটি দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো-
১. পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস-কে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন (রি-কনস্ট্রাকশন) অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তি আমানতকারীদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় দ্রুত ফেরত দেয়া।
২. চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যক্তি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩. অবিলম্বে পিপলস লিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া। বিশেষ করে তারা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য তাদের বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা, তাদের সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা।
সংবাদ সম্মেলনে আমানতকারীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন কাউন্সিলের প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে তিনি বলেন, আমরা মনে করি বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
“আমাদের আকুল আবেদন, এখনই পিপলস লিজিং-কে অবসায়ন না করে ব্যক্তি আমানতকারীদের আমানত দ্রুত ফিরিয়ে দিয়ে সরকার যেভাবে ফারমার্স ব্যাংক-কে অবসায়ন না করে পদ্মা ব্যাংক নামে পুনর্গঠন করে গ্রাহকদের আমানত ফিরিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি পিপলস লিজিং-কে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন করে নতুন নামে চালু এবং গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
আতিকুর রহমান আতিক বলেন, আমাদের সকল সঞ্চয় লুট করে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকসহ অন্যান্যরা আরাম-আয়েশি জীবন-যাপন করছে, বিদেশে গিয়ে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এমন দুর্নীতি তিনি কখনওই প্রশ্রয় দেবেন না বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমরা পিপলস লিজিংয়ের প্রতারণার শিকার। আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের বাঁচানোর পথ সুগম করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করছি। আমরা আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত আমাদের মতো অসহায় আমানতকারীদের জীবন বাঁচাবে এবং বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, আমরা প্রায় ছয় হাজার আমানতকারী সরল বিশ্বাসে আমাদের সঞ্চিত ও কষ্টার্জিত অর্থ আমানত হিসাবে পিপলস লিজিংয়ে জমা রেখেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আমরা, পিপলস লিজিংয়ের ক্ষুদ্র আমানতকারীরা কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত পাচ্ছি না।
“ফলে আমরা চরম অসহায় অবস্থায়, দুশ্চিন্তায় দিন যাপন করছি। কোথায় গেলে এ টাকা ফেরত পাব, তার কোনো নিশ্চয়তাও পাচ্ছি না। আমাদের হাজারও আমানতকারী এবং তাদের লক্ষাধিক পরিবারের সদস্য এক অনিশ্চিত জীবন-যাপন করছে। এ টাকা থেকে অনেক অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সংসারের ব্যয় নির্বাহ হতো, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চলত, চিকিৎসায় ব্যয় হতো। আজ সব বন্ধ। ইতোমধ্যে এক আমানতকারী টাকা ফেরত পাবার অনিশ্চয়তায় হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছেন। ক্যান্সার আক্রান্ত এক আমানতকারী অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন না”- যোগ করেন আতিক।
তিনি বলেন, উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের লুটপাট ও অনিয়মের কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে পিপলস লিজিং। আমানতকারীদের আমানত তারা ফেরত দেয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংয়ের ওপর সঠিক নজরদারি না করায় একটি অসাধু চক্র, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন কৌশলে, নামে-বেনামে আমানতকারীদের অর্থ বাগিয়ে নিয়েছে। এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। পরিকল্পনা মাফিক তারা প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়নের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
পিপলস লিজিংয়ের আমনতকারীদের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, আমরা ভীত যে, এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে চক্রটি সমস্ত দায়দেনা থেকে মুক্তি পাবে এবং বিদেশে পাচার হবে শত কোটি টাকা। এটি একটি দুর্নীতির মডেল তৈরি হবে, যা ভবিষ্যতে অন্যান্য ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান সহজেই অনুসরণ করতে চাইবে এবং দেশের অর্থনীতিকে অস্থীতিশীল করে তুলবে।
“এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা রহস্যজনক” বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, পিপলস লিজিংয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে এখন আমানতকারীরা টাকা পাচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়নের পথে নিয়ে হাজার হাজার আমানতকারীকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে। পিপলস লিজিংয়ের এ অবস্থার কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং খাত বিপদের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে এবং সাধারণ জনগণ ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে তাদের আমানতের টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক নজরদারি ও সঠিক তদারকি না করার কারণে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকরা অনিয়ম ও দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছে।
আতিক বলেন, ছয় হাজার আমানতকারীর আমানত ফেরতের ব্যবস্থা না করে ব্যাংলাদেশ ব্যাংক একতরফাভাবে পিপলস লিজিং-কে গত জুলাই মাসে অবসায়ন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পূর্ণ দায়ভার, দ্রুত ব্যক্তি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া। কিন্তু বাস্তবে প্রায় পাঁচ মাস চলছে এখনও বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তি আমানকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া শুরু করেনি। তাই তারা দুশ্চিন্তায় দিনযাপন করছে।
“বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্বাহী পরিচালক বিভিন্ন মিডিয়াতে বলেছেন, পিপলস লিজিংয়ের সম্পদের চেয়ে লাইবেলিটি বা দায়দেনা কম আছে। তাহলে আমাদের প্রশ্ন, ব্যক্তি আমানতকারীদের ৭০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত দিতে দেরি করছে কেন। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, বন্ধ হয়ে যাওয়া পিপলস লিজিংয়ের সম্পদের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তিন হাজার ২৩৯ কোটি টাকা বলা হলেও চলতি বছর ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের সম্পদের পরিমাণ এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বিপরীতে দায় আছে দুই হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ঋণ দিয়েছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৫৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে পিপলস লিজিংয়ের উদ্যোক্তা পরিচালকরা।”
কাউন্সিলের আহ্বায়ক মো. আনোয়ারুল হক-সহ সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিতি ছিলেন প্রশান্ত কুমার দাস, রানা ঘোষ, কামার আহমেদ, সামিয়া বিনতে মাহবুব, আবু নাসের বখতিয়ার, ড. নাশিদ কামাল প্রমুখ।
শেয়ারবার্তা / আনিস