চলতি অর্থবছরের আট মাস পেরিযেছে। এখনো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারেনি দেশের রফতানি খাত। ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই—আট মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কমেছে তৈরি পোশাক রফতানি। অর্থবছরের বাকি চার মাসেও রফতানি ইতিবাচক ধারায় ফেরা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বাংলাদেশ থেকে ৩৩১ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়, যা ছিল গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের প্রথম মাসে প্রবৃদ্ধির মুখ দেখলেও এর পরের মাসেই বড় ধরনের পতন ঘটে পোশাক রফতানিতে। আগস্টে প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এরপর সেপ্টেম্বরে ৪ দশমিক ৭, অক্টোবরে ১৯ দশমিক ৭৯ ও নভেম্বরে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয় রফতানিতে। ডিসেম্বরে রফতানি আবার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে। ওই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারিতে আবারো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে চলে যায় পোশাক রফতানি। ওই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি ইপিবি। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান বলছে, ফেব্রুয়ারিতে পোশাক রফতানিতে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, সমাপ্ত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রফতানি হয়েছে ২৫৯ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে পোশাক রফতানি হয় ২৭৫ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার ডলারের। এ হিসাবে ফেব্রুয়ারিতে পোশাক রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ ধারণ করেছে নভেল করোনাভাইরাস। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি বাজার ইউরোপের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে এ ভাইরাসের সংক্রমণ। এরই মধ্যে প্রধান উৎস দেশ চীন থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে অর্থবছরের বাকি চার মাসে রফতানিতে ইতিবাচক ধারা ফিরে আসার কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে আরো কমে যেতে পারে রফতানি।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, পোশাক রফতানি পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, পোশাক খাতের অবস্থা কতটা নাজুক। সমস্যা এখনো অব্যাহত। করোনাভাইরাসের প্রভাবে হয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
ইপিবি’র পরিসংখ্যান বলছে, অর্থবছরের বিভিন্ন মাসের সমন্বিত হিসাবেও পোশাক রফতানির ধারা নেতিবাচক। জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পর জুলাই ও আগস্ট দুই মাসে পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জুলাই-অক্টোবর, জুলাই-নভেম্বর, জুলাই-ডিসেম্বর, জুলাই-জানুয়ারিতে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ঋণাত্মক ৬ দশমিক ৬৭, ৭ দশমিক ৭৪, ৬ দশমিক ২১ ও ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। সর্বশেষ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি—আট মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপের প্রায় সব ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানই আগের তুলনায় পোশাক কম কিনছে। এসব ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে সিঅ্যান্ডএ, প্রাইমার্ক, এইচঅ্যান্ডএম ও আলদি। তবে ক্রেতারা কী পরিমাণে কম কিনছে, তা নিশ্চিত করে কেউ জানাতে পারেনি। সব মিলিয়ে অন্য বছরগুলোর তুলনায় ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয় ১০-১৫ শতাংশ কমিয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান।
গত দু-তিন বছরে একের পর এক বন্ধ হয়েছে পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রয়কেন্দ্র। পোশাক কেনার ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের ঝোঁক এখন অনলাইনকেন্দ্রিক, যার প্রভাবে খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের পোশাকের চাহিদা কমেছে। এ প্রবণতা ইউরোপের বাজারগুলোতেই বেশি বলে দাবি পোশাক রফতানিকারকদের। এ অবস্থায় ক্রেতারা যে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন, তার মূল্য আগের চেয়ে কম। আবার ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী টাকায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছেন রফতানিকারকরা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় সর্বশেষ আঘাত নভেল করোনাভাইরাস।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি থাকলেও ইউরোপের বাজারে রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। পাশাপাশি অপ্রচলিত বাজারগুলোতেও রফতানির অবস্থা ভালো নয়। কারণ ক্রেতাদের প্রস্তাবিত মূল্য আগের চেয়ে কম। আবার ক্রয়াদেশের পরিমাণও কম। তবে মূল্যটাই বেশি প্রভাব ফেলছে, ক্রয়াদেশ নেয়া যাচ্ছে না।
এনবিআর থেকে সংগৃহীত তথ্য সংকলনের মাধ্যমে বিজিএমইএ যে তথ্য দিয়েছে, তাতেও পোশাকের মূল্য কমে যাওয়ার চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। সংগঠনটির দাবি, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পোশাকের কেজিপ্রতি মূল্য ছিল ১৩ দশমিক ৯১ ডলার। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে পোশাকের কেজিপ্রতি মূল্য ছিল ১৩ দশমিক ৮০ ডলার। এ হিসাবে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পোশাকের মূল্য কমেছে দশমিক ৭৯ শতাংশ।
এদিকে রফতানিতে বিদ্যমান ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির মধ্যে পোশাক খাতের সংকটে নতুন করে যুক্ত হয়েছে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস। দেশের পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বড় উৎস চীন। দেশে বস্ত্র শিল্পের আমদানীকৃত কাঁচামালের ৪৬ শতাংশই আসে চীন থেকে। কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ায় দেশটি থেকে কাঁচামাল সরবরাহ ব্যবস্থা এখন প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সামনের দিনগুলোয় এ পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে শুধু টেক্সটাইল ফাইবার ও টেক্সটাইল আর্টিকেলস ছিল ৫ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারের। কাঁচামালের প্রধান সরবরাহকারী দেশটির চলমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের উৎপাদনমুখী শিল্পের ব্যবসাকে বড় ধরনের দুর্যোগের মুখে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিট পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শুধু ফেব্রুয়ারিকে বিবেচনায় নিলে ওই মাসের রফতানি কমে যাওয়ার সঙ্গে করোনার কিছুটা সম্পর্ক আছে। চীনে পোশাকপণ্যের যে রফতানিগুলো হতো, সেগুলো কিন্তু এখন এক-দেড় মাস ধরে হচ্ছে না। আমার নিজের কারখানায়ই এক মাসে চীনে রফতানির জন্য তৈরি করা পণ্য পড়ে আছে। আর সামগ্রিকভাবে রফতানি নেতিবাচক মূলত হচ্ছে ইউরোপে। নিট ও ওভেন দুই ধরনের পণ্যেরই রফতানি ইউরোপে কমে গেছে। ওখানে অনলাইন সেল বেড়ে গেছে, খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পোশাক কেনাকাটা কম হচ্ছে। ইউরোপে সারা বছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসা-যাওয়া করে। এ পর্যটকরাই খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পোশাক বেশি কিনত। করোনাভাইরাস আতঙ্কে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকের আগমন ব্যাপক হারে কমেছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে মুদ্রা শক্তিশালীর মতো আগের বড় কারণগুলো এখনো বাংলাদেশ থেকে পোশাকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। সব মিলিয়েই পোশাকের রফতানি এখনো নেতিবাচক।
রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাক খাতের রফতানি কমে যাওয়া মানেই দেশের মোট রফতানিও কমেছে। কারণ মোট রফতানির ৮৪ শতাংশই হয় পোশাক। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি—সাত মাস পর্যন্ত পোশাকের পাশাপাশি মোট রফতানিও ছিল নেতিবাচক। সাত মাস শেষে মোট রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ। করোনার প্রভাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চীনা ক্রেতারাও চামড়া ক্রয় বন্ধ রেখেছেন।
সার্বিক রফতানি পরিস্থিতি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি খুবই আশঙ্কাজনক। বিশ্ববাজারে অঘোষিত মন্দা চলছে। এটা বেশি দেখা যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে, যেখানে আমাদের ৬০ শতাংশ পণ্য রফতানি হয়। আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কারণে আমাদের কাছে আসতে পারত এমন ক্রয়াদেশগুলো ডাইভার্ট হয়ে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে যাচ্ছে। এ অবস্থা কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা নির্ভর করছে কবে আমরা হারানো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ফিরে পাব তার ওপর।
শেয়ারবার্তা / আনিস