দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত নতুন কোন লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়নি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দু’ বীমা করপোরেশনে। পাকিস্তান আমলে যারা ছিলেন তাদের দ্বারাই চালিয়ে নেয়া হচ্ছিল করপোরেশন দু’টি। ২০০০ সালের দিকে এদের প্রায় সবাই অবসরে চলে যান। পরবর্তিতে তারা প্রাইভেট বীমা কোম্পানির নেতৃত্বে আসেন। কিন্তু বয়সের ভারে তাদের অনেক এখন নেই। মূলত ২০০০ সালের পর থেকে খাতটিতে দক্ষ লোকবল সংকট প্রকট হয়ে ওঠে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা ব্যবসার ৩৭ শতাংশ শেয়ার মেটলাইফের দখলে। স্বাধীনতার আগে থেকেই বহুজাতিক এ কোম্পানিটি এখানে ব্যবসা করছে। কিন্তু এরপরও এদেশের বীমাখাতে দক্ষ লোকবল তৈরির পেছনে তাদের কোন ভূমিকা নেই। তারা শুধু নিজেদের ব্যবসাই দেখেছে।
এ প্রসঙ্গে গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির এ চৌধুরি বলেন, আমি পাকিস্তান ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনে ক্যারিয়ার শুরু করি। পরবর্তিতে দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন বা বর্তমান সাধারণ বীমা করপোরেশনে নিয়োগ পাই। ১৯৮৫ সালে সালে সরকার বেসরকারি খাতে বীমা কোম্পানি গঠনের অনুমোদন দেয়। এরপরই আমি স্বেচ্ছায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে অব্যাহতি নেই। এবং ১৯৮৬ সালে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স গড়ে তুলি। আমি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ লোকবল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু অন্যেরা সেভাবে নেয়নি। কোন দক্ষ লোকবল তৈরি না হওয়ায় ক্রমেই অদক্ষ ও অপেশাদার লোকজন ঢুকে পরে খাতটিতে । যার ফলে স্বাধীনতার এতো বছর পরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এদেশের বীমাখাত।
পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টা ও সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তান আমলের লোকজন দ্বারাই দীর্ঘ একটি সময় পর্যন্ত এদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব দু’ বীমা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই দুই প্রতিষ্ঠানে নতুন কোন লোকবল নিয়োগ হয়নি। আবার বেসরকারি খাতে কোম্পানি অনুমোদনের পর থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই বেসরকারি কোম্পানিতে চলে আসে। ২০০০ সালের দিকে অনেকেই অবসরে চলে যান। কিন্তু ওই সময় যারা বেসরকারি খাতে কাজ শুরু করেন তাদের প্রত্যেকে যদি যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ লোকবল তৈরির উদ্যোগ নিতেন তাহলে এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হতো না।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যেও পেশাদার লোকবলের অভাব রয়েছে। ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া যে দেশই বলেননা কেন সেখানকার বীমাখাতের রেগুলেটরি অথরিটিতে যারা থাকেন তাদের প্রত্যেকেই বীমাবিদ। এটা একটি কারিগরি বিষয়। তাই এ বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান ছাড়া খাত পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো অপেশাদার লোক দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে আমাদের বীমাখাত। এ খাতে দক্ষ লোকবল গড়ে তোলার উদ্যোগ কখনোই কোন সরকার নেয়নি।
আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা বলেন, দক্ষ ও পেশাদার লোকবল তৈরির উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল বাংলাদেশ বীমা একাডেমির। এছাড়া বিভিন্ন বীমা কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও নিম্নপদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। এরই মধ্যে আরও বেশ কিছু নতুন কোম্পানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু ব্যবসার গুণগত প্রসার ঘটেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাজার কোটি টাকার দাবি নিরূপন ও পরিশোধ, কোম্পানির সম্পদ ও দায় মূল্যায়ন (একচ্যুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশন), আন্ডাররাইটিং, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সলভেন্সি মার্জিন, প্রিমিয়াম রেট নির্ধারণ, অ্যাকাউন্টিংয়ের ভিন্নতা প্রভৃতি জটিল সব বিষয় নিয়েই বীমাখাত। অথচ এমন কারিগরি ও কৌশলগত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ কর্র্তপক্ষ বা কোম্পানি সব জায়গাতেই দক্ষ ও পেশাদার লোকবলের সংখ্যা সিমিত।
অবশ্য অপেশাদার কর্তৃপক্ষ গঠনের পেছনে সংশ্লিষ্ট আইনটিকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০ এর ৭ ধারায় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের যোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, বীমা, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং, মার্কেটিং, পরিসংখ্যান, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন বা আইনে অন্যূন ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি চেয়ারম্যান বা সদস্য হবার যোগ্য হবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনে যদি বীমা বিষয়ে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক পড়ালেখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতো তাহলে একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা সহজ হতো। তখন নিজেদের প্রয়োজনেই অনেকে বিদেশে গিয়ে বীমা বিষয়ে পড়ালেখায় উৎসাহিত হতেন।
শেয়ারবার্তা/ সাইফুল