গ্রাম ও শহরের স্বল্প আয়ের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর সংসার চলে ডাকঘরে জমানো টাকার মুনাফা দিয়ে। কিন্তু সরকারের একটি সিদ্ধান্তে তাদের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা এখন অর্থ রাখবে কোথায়?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লুটপাট ও অনিয়মের কারণে গত কয়েক বছর ধরে দেশের বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে। ফলে বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হয়ে উঠেছিল ডাকঘর। তার প্রমাণ মেলে ডাকঘরে মানুষের অর্থ জমানোর হিসাব কষলে। কিন্তু সেই সঞ্চয়পত্র্রের সুদ কমিয়ে অর্ধেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষ এখন সঞ্চয় করতে নিরুৎসাহিত হবে। বেশি লাভের আশায় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানিতে টাকা রেখে নিঃস্বও হতে পারে।
জানা গেছে, অধিক সুদ এবং অর্থ ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকায় ডাকঘর সঞ্চয় হিসাবে মানুষের অর্থ জমার পরিমান গত কয়েক বছর ধরে অব্যহতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ হিসাবে (ডাকঘর) অর্থ জমার পরিমান চার বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জমা হয়েছে ২ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জমা পড়েছিল ১ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা।
ডাকঘরে স্থায়ী আমানত জমারও একই ধরা লক্ষ্য করা গেছে।
সঞ্চয়কারীরা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৯৫২ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত খুলেছেন ডাকঘরে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জমা রেখেছেন ৫২১০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ডাকঘরের সাধারণ সঞ্চয় হিসাবে আমানতের পরিমান ১ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। স্থায়ী আমানতের পরিমান ৭ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সাধারণ সঞ্চয় স্কিমে জমা হয়েছে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। স্থায়ী আমানতে ১০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাধারণ সঞ্চয় স্কিমে জমার পরিমান ৩ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। স্থায়ী আমানতের পরিমান ১১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ডাকঘরের উপ-মহাপরিচালক খন্দকার শাহনুর সাব্বির বলেন, ডাকঘরে আমানত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ অধিক মুনাফা।
আমানতের অধিক মুনাফা প্রদানকারী মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে তারা এখন মার্কেটে নেই।
এসব মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির অনুপুস্থিতিতে মানুষ ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের প্রতি আগ্রহী হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা জিপিওর একজন জ্যেষ্ঠ পোস্ট মাস্টার বলেন, শহর এবং গ্রামের বিপুল পরিমান ক্ষুদ্র আমানতকারী তাদের অর্থ ডাকঘরে জমা করে।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ার পর্যন্ত ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের তিনবছর মেয়াদী স্থায়ী আমানতের সুদহার ছিল ১১ ধমমিক ২৮ শতাংশ, যা ব্যাংকের সুদের চেয়ে অনেক বেশি।
ডাকঘরের সাধারণ হিসাবের সুদের হারও ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, সেটাও ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবের চেয়ে বেশি।
ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার কমানোর ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। এতে মানুষ আবার মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকার তিনবছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের ১১ দশমিক ২৮ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করে। সরকার এটি করে ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার কমিয়ে আনার কারণে।
গত সপ্তাহেও ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার সঞ্চয়পত্রের সুদহারের কাছাকাছি ছিল। তবে সঞ্চয়পত্রের সুদহার অপরিবর্তিত থাকলেও সঞ্চয় স্কিমের সুদহার কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, ব্যাংকের আমানতের সুদের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতেই ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদহার কমানো হয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বলছে, ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদ কমানোর ফলে প্রথমবারের মত ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহারের ব্যবধান তৈরি হলো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সরকারের সবশেষ পদক্ষেপের ফলে মানুষ সঞ্চয় করতে নিরুৎসাহিত হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবের সুদের হার জোর করে কমানো হয়েছে। এখন আবার কমানো হলে ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের। বাজার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে এমন উদ্যোগ অর্থনীতিতে ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০১৯ সালের জুন শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমান ২ লাখ ৮৯ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে ডাকঘর সঞ্চয় স্কিম ও মেয়াদী আমানতের অর্থ রয়েছে ১৩ দশমিক ৯৭শতাংশ।
সমালোচনার মুখে ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার বিবেচনার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। মানুষের আস্থা ধরে রাখতে কতটুকু বিবেচনা করা হবে এবং তা কতটা কাজে আসবে, সেদিকেই তাকিয়ে সবাই।
শেয়ারবার্তা / মিলন