ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল বা এফআরসি বাংলাদেশ কর্তৃক কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নতুন বিধান প্রণয়ন করেছে। নতুন এ বিধানের ফলে এখন থেকে কোনো কোম্পানি শেয়ারের নামে জমা নেওয়া অর্থ বা শেয়ার মানি ডিপোজিট ছয় মাসের বেশি অলস ফেলে রাখতে পারবে না। টাকা নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ওই টাকাকে মূলধনে রূপান্তর করতে হবে। ইস্যু করতে হবে নতুন শেয়ার। সম্প্রতি এফআরসির পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
এফআরসি বলছে, নতুন বিধানটি কার্যকর করা হলে তাতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্তির বাইরে থাকা অনেক কোম্পানির শেয়ার মানি ডিপোজিটকে মূলধনে রূপান্তর করতে হবে। অনেক কোম্পানিকে এ জন্য নতুন করে শেয়ার ইস্যু করতে হবে। শেয়ার মানি ডিপোজিটের টাকা মূলধনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস হিসাব করার ক্ষেত্রে এ অর্থকে বিবেচনায় নিতে হবে। তাতে অনেক কোম্পানির ইপিএস হঠাৎ করে উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এফআরসির নতুন বিধানে বলা হয়েছে, মূলধন খাতে প্রাপ্ত অর্থ যা শেয়ার মানি ডিপোজিট বা অন্য কোনো নামে কোম্পানির মূলধন বা ইক্যুইটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই প্রত্যাহার বা ফেরত নেওয়া যাবে না। শেয়ার মানি ডিপোজিট বা এ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে আইনগতভাবে মূলধনে রূপান্তর করতে হবে। মূলধনের রূপান্তরের আগ পর্যন্ত ওই অর্থের বিপরীতে সম্ভাব্য শেয়ারকে বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানির ইপিএস গণনা করতে হবে। নতুন এ বিধান সরকারি প্রজ্ঞাপন আকারে জারির অপেক্ষায় রয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই বিধানটি কার্যকর হবে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে এফআরসির নির্বাহী পরিচালক সাঈদ আহমেদ বলেন, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে নতুন বিধানটি কার্যকর হবে। আইন অনুযায়ী, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর জন্য এ বিধান পরিপালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এফআরসির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন এ বিধানের ফলে কোম্পানির আর্থিক ভিত্তির প্রকৃত তথ্য পাবেন বিনিয়োগকারীরা। এ ছাড়া শেয়ার মানি ডিপোজিটের অপব্যবহারও বন্ধ হবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন।
প্রজ্ঞাপনের জন্য যে বিধানটি পাঠানো হয়েছে সেখানে এফআরসির চেয়ারম্যান সি কিউ কে মুসতাক আহমদ উল্লেখ করেছেন, কোম্পানির শেয়ার ইস্যু করা হবে এ প্রতিশ্রুতিতে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ বা সম্পত্তি গ্রহণ করে তা শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসেবে রাখা হয়। পরে সেই টাকা ইক্যুইটি বা মূলধন হিসেবে দেখিয়ে বিভিন্ন কৌশলে অপব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ইপিএস গণনার ক্ষেত্রে এ অর্থকে বিবেচনায় না ধরে উচ্চ হারে ইপিএস দেখানো হয়। এসব প্রবণতা রোধে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন-২০১৫-এর ক্ষমতাবলে এফআরসি এ-সংক্রান্ত নতুন বিধান জারি করছে।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানি ও নিরীক্ষাকাজের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এফআরসির উদ্যোগটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে এ বিধান কার্যকরের ক্ষেত্রে কিছু কোম্পানি প্রাথমিকভাবে জটিলতায়ও পড়বে। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জটিলতায় হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এসব কোম্পানিতেই সবচেয়ে বেশি শেয়ার মানি ডিপোজিট রয়েছে। এসব ডিপোজিটের বিপরীতে নতুন করে শেয়ার ইস্যু করা হলে তাতে কোম্পানিগুলোতে সরকারের মালিকানার অংশ আরও বেড়ে যাবে। কারণ, শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসেবে সরকারি কোম্পানিগুলোতে যে অর্থ জমা রয়েছে, তা মূলত সরকারই বিভিন্ন সময় কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করেছে।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পাওয়ার গ্রিডের কথা। কোম্পানিটির ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে। এখন এ অর্থকে মূলধনে রূপান্তর করা হলে তাতে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন বেড়ে প্রায় ৬ হাজার কোটিতে দাঁড়াবে। পাশাপাশি বেড়ে যাবে বিপুল পরিমাণ শেয়ার। যার মালিকানা যাবে সরকারের হাতে। শেয়ারের পরিমাণ বেড়ে গেলে কোম্পানিটির ইপিএসও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে। একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি মালিকানাধীন অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রেও। তাই নতুন বিধানটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একই সঙ্গে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করতে হলে সেটি কী দামে ইস্যু করা হবে। যদি অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুতে ইস্যু করা হয় তাহলে লাভবান হবেন উদ্যোক্তারা। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজারমূল্যের ভিত্তিতে নতুন শেয়ার ইস্যু করলে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
জানতে চাইলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের চেয়ারম্যান মাসুদ খান বলেন, এফআরসির উদ্যোগটি প্রশংসনীয়, তবে এটি কার্যকর করতে গিয়ে শেয়ারবাজারে যাতে নেতিবাচক কোনো প্রভাব না পড়ে, সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
শেয়ারবার্তা / আনিস