গত এক বছরে গাজিপুরে ১৭৮টি ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মূল কারণ হলো গ্যাস–সংকট, বিদ্যুৎ সমস্যা ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি। এরফলে বেকার হয়েছেন এক লাখের বেশি শ্রমিক। এতে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পোশাকশিল্পের মালিকেরা কারখানা বন্ধ হওয়ার জন্য বিভিন্ন বিষয়কে দায়ী করেছেন। তাঁরা বলছেন, গত বছর শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পায়। যে কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কমপ্লায়েন্স বা কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নের কারণেও খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা তো রয়েছেই। অন্যদিকে পোশাকের মূল্য বৃদ্ধি করেননি ক্রেতারা। আবার পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশও থাকে না অনেক সময়।
পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, কারখানার মালিক ও শ্রমিক এবং গাজীপুরের শিল্প পুলিশের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে গাজীপুর জেলায় মোট ১৭৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে ৭৬টি তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য এবং পাঁচটি নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য। বাকিগুলো সাবকন্ট্রাকটিং বা ঠিকা ভিত্তিতে কাজ করে এমন ধরনের কারখানা। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোয় কাজ করতেন প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তাঁদের মধ্যে অল্পসংখ্যক অন্য কারখানায় কাজ পেলেও অধিকাংশ এখনো বেকার রয়ে গেছেন। বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি হলো—ডডি এক্সপোর্টওয়্যার, প্যাসিফিক এ ওয়ান সোয়েটার, টেল্টা কোয়ালিটি, ওয়াগা স্টাইল ওয়াইজ, মার্ক মুড, ইউন্টেরিয়া টেক্সটাইল, ডিভাইন টেক্স সোয়েটার, আসিফ অ্যাপারেলস, এহসান ফ্যাশন, জারা ডেনিম, এলিগেন্স ওরিয়েন্টাল, সুপ্রিম ইন্ডাষ্ট্রিজ, অটো স্পিনিং, রেপিশন অ্যাপারেলস।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্ধ কারখানাগুলোর বেকার শ্রমিকদের বেশির ভাগই নতুন চাকরি না পেয়ে নিজ নিজ গ্রামে চলে গেছেন। তাঁদের অনেকেই বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে না পেরে রাতের আঁধারে বাসা ছেড়েছেন। যে কারণে তাঁরা যেসব বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেগুলো খালি পড়ে আছে। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এলাকা ছেড়ে যাওয়ায় মহল্লায় মহল্লায় গড়ে ওঠা মুদিদোকানসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিক্রি–বাট্টা কমেছে। এর প্রভাবে স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
জানতে চাইলে গাজীপুরের ওয়ার্কফিল্ড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসান বলেন, গত কয়েক বছরে অনেক কারণে পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই তুলনায় ক্রেতারা মূল্য বৃদ্ধি না করে উল্টো কমিয়েছে। তা ছাড়া কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নের জন্য মালিকদের প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অনেকের আবার সেই সামর্থ্য না থাকায় কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া এলাকার ম্যানট্রাস্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তাতে দেড় হাজার শ্রমিক বেকার হন। মারুফ হোসেন নামে ওই কারখানার একজন শ্রমিক বলেন, ‘ছেলে–মেয়ে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। কারখানা বন্ধের পর অন্য কোথাও কাজ পেলাম না। বাধ্য হয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছি। সারা দিন কষ্ট করেও আগের মতো আয় হচ্ছে না।’ তিনি জানান, ম্যানট্রাস্ট কারখানায় তাঁর অনেক সহকর্মী চাকরি না পেয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। সেখানে কেউ কেউ দোকান দিয়েছেন। কেউ আবার অটোরিকশা চালিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন।
গাজীপুর মহানগরীর ছয়দানা এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সাঈদ আলী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ছয়তলা বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ির ২৪টি ফ্ল্যাটে পোশাকশ্রমিকেরা ভাড়া থাকতেন। কিন্তু তিন মাস ধরে ১৫টি ফ্ল্যাটই খালি রয়েছে। সাঈদ আলী বলেন, ‘একের পর এক পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে ভাড়াটে মিলছে না। অধিকাংশ ফ্ল্যাট খালি পড়ে থাকায় ব্যাংকের কিস্তিও দিতে পারছি না। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে ব্যাংকের কিস্তি ও সংসার চালানো দায়। এভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় নামতে হবে।’
বিসিক শিল্পনগরের নাইটিঙ্গেল ফ্যাশন লিমিটেডের তিনটি কারখানা গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে বন্ধ। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম জানান, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় মাসের পর মাস লোকসান গুনতে হচ্ছিল। তাই কারখানাগুলো বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক গত বছর গাজীপুরে বিজিএমইএর ৭৬টি সদস্য পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধির পর কারখানাগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। বড় কারখানাগুলো তা কোনোরকমে সামলে নিতে পারলেও ছোটরা পারছে না। ফলে বন্ধ হচ্ছে কারখানা। বর্তমানে ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশ পরিপক্ব হয়ে ওঠায় প্রতিযোগিতা বহুলাংশে বেড়ে গেছে। প্রতিযোগিতা–সক্ষমতায় টিকতে না পারায় আমরা আমাদের ব্যবসার হিস্যা হারাচ্ছি।’ সূত্র: প্রথম আলো।
শেয়ারবার্তা / হামিদ