অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার সময়ে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়তে দেবেন না তিনি। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বাড়তে থাকে। তখন খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকেন তিনি। বিশেষ সুযোগ, এককালীন এক্সিট সুবিধা, আইন শিথিল, অবলোপন নীতিমালায় ছাড়, স্বল্প সুদের ঋণের ব্যবস্থাসহ ঋণ খেলাপিদের নানা বিশেষ সুবিধা দিয়ে সমালোচনা সহ্য করার পর বছরান্তে সফল হয়েছেন মুস্তফা কামাল।
বছর ঘুরে দেখা যাচ্ছে, নিয়মিত হিসাবে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি। শতাংশের হিসাবে বেশ খানিকটা কমেছে।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মোট ঋণ ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ডিসেম্বর পর্যন্ত (অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক) যত টাকার ঋণ বিতরণ করেছে তার ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। সেপ্টেম্বর (প্রথম প্রান্তিক) শেষে এই হার ছিল ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কাগজে-কলমে ২২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ কিন্তু ৪২০ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমায় সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, সরকারের কড়া নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ বেশ তৎপরতা চালিয়েছে। অনেক বকেয়া ঋণ আদায় করেছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য সবাই চেষ্টা করছে।
তবে তিনি স্বীকার করেন, সরকার ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করার যে ‘বিশেষ’ সুযোগ দিয়েছিল, তা খেলাপি ঋণ কমাতে অবদান রেখেছে।ঋণ খেলাপিদের নানা সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা শুরু থেকেই হয়ে আসছে।
সোমবারও এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ অর্থনীতির আকার অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
তিনি বলেন, নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ রিশিডিউলড না করলে এর আকার দাঁড়াত দ্বিগুণ। সরকার ঋণখোলাপিদের শাস্তি না দিয়ে কনশেসন দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।
ঋণ খেলাপিদের নানা সুবিধার প্রভাবই খেলাপি ঋণের হিসাবে পড়েছে বলে মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখতও। তিনি বলেন, ঋণ খেলাপিরা ‘বিশেষ’ সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেক ঋণ নিয়মিত করায় (পুনঃতফসিল) খেলাপি ঋণ বাড়েনি। তবে ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায় করার চেষ্টা করেছে।
তবে ‘বিশেষ’ সুবিধা নিয়ে যে সব ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে সেগুলো যাতে ফের খেলাপি না হয় সেদিকে ব্যাংকগুলোকে সজাগ দৃষ্টি রাখার পরমর্শ দিয়েছেন বিআইডিএসের এই গবেষক।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নানা সুযোগ নিয়ে ৫০ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ এক বছরে বাড়লেও ব্যাপক হারে পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ায় প্রথমবারের মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনায় সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে।
২০১৯ সালের শুরুতে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর প্রথমে খেলাপি নীতিমালায় শিথিলতা আনা হয়। আগে ৩ মাস অনাদায়ী থাকলেই তা খেলাপি হিসেবে শ্রেণিকরণ করতে হত। এটি সংশোধন করে ৬ মাস এবং সর্বোচ্চ ১২ মাস করা হয়। অন্যদিকে খেলাপিদের বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করা হয়।
গত বছরের মে মাসে জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়, ঋণ খেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের মেয়াদে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন।
একইসঙ্গে নতুন করে যারা ঋণ নেবেন তাদের জন্য এপ্রিল মাস থেকে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমানতকারীদের সুদহার ৬ শতাংশ এবং ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
‘বিশেষ’ সুবিধার আওতায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছে ব্যাংকগুলো। যার অর্ধেকই করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েও গত বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ৫২ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
এর বাইরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করেছে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে এই অর্থ বাদ যাবে, যদিও তা আর ফেরত আসছে না।
শেয়ারবার্তা / আনিস