ঋণখেলাপিদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলেও সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরা করা হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংক আমানতের সুদ আগের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে সুদহারও অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর আগে দফায় দফায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৮ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম বিক্রি হয়েছে সঞ্চয়পত্র। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, বিক্রির চেয়ে ভাঙানো হয়েছে বেশি। এর কারণে সর্বশেষ গত ডিসেম্বর মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হয়েছে বেশি। এতে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় নেমেছে, এর পরিমাণ মাইনাস ৪০৮ কোটি টাকা। আগের মাস নভেম্বরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল মাত্র ৩২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২০ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৭৮ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২০১২ সালের পর এই প্রথম নেবিবাচক ধারায় ফিরেছে। এর আগে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাইনাস ৯ কোটি বিক্রির চেয়ে ভাঙানো হয়েছে বেশি ৯ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় না করে তাদের আরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ঋণের সুদহার কমাতে গিয়ে আমানতের সুদ অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের সাধারণ সঞ্চয়কারীরা। এখন ডাকঘর সঞ্চয়পত্রেও সুদ অর্ধেক নামিয়ে আনা হয়েছে, এখানেও সাধারণ সঞ্চয়কারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহ করতে সরকার ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সুদের হার কমিয়ে প্রায় অর্ধেকে করেছে। তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে যারা এত দিন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পেতেন, তারা এখন থেকে পাবেন ৬ শতাংশ হারে। গত বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বৃহস্পতিবার থেকেই নতুন এই সুদহার কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই প্রজ্ঞাপনে।
সরকারের ব্যয় কমানোর অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর উদ্যোগ নিলেও তাতে সত্যিকার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘খেলাপিদের থেকে টাকা আদায় না করে উল্টো তাদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আবার যারা সঞ্চয় করার সুযোগ পেতো, তাদের ওপর নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় এখন তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার ব্যাংক খাতেও উন্নতি হচ্ছে না।’
এর আগে জুলাই থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া, এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সঞ্চয়পত্রের সব লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করতে হচ্ছে ক্রেতাদের। পাশাপাশি অভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি জারি করা নতুন প্রজ্ঞাপনে তিন বছর মেয়াদে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। আগে যা ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। দুই বছর মেয়াদের সঞ্চয়পত্রে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এছাড়া এক বছর মেয়াদে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ। আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ।
জানা গেছে, ডাকঘর সঞ্চয়পত্র সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি নাগরিক কিনতে পারেন। নাবালকের পক্ষেও এ সঞ্চয়পত্র কেনা যায়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন গ্রাহক।
প্রসঙ্গত, বাজেট ঘাটতি পূরণে প্রতিবছরই সরকার সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেয়। এই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
শেয়ারবার্তা / মিলন