নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে। এখন ওই সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এর ফলে নাজুক অবস্থা দেখা দিয়েছে ওই সব প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিতে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ১০টিতে পৌঁছেছে। অত্যন্ত নাজুক এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড’ শ্রেণীভুক্ত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর-ভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তৈরি চাপ সহনশীল (স্ট্রেস টেস্টিং) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘রেড’জোনে ফেলেছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা জানার জন্য কয়েকটি সূচকের ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে নিরীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্য অভিঘাত- এ চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়। নিরীার ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। ভালোগুলোকে ‘গ্রিন’ জোন, ভালোর চেয়ে একটু খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ইয়েলো’ জোন এবং চরম খারাপ অবস্থায় থাকাগুলোকে ‘রেড’ জোন শ্রেণীভুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৯ সালের সর্বশেষ সেপ্টেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকির বিচারে ‘গ্রিন’ জোনে রয়েছে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ ঝুঁকির বিবেচনায় ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাকি ২৯টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই নাজুক।
নাজুকের মধ্যে ১৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ‘ইয়েলো’ জোনে। আর সবচেয়ে বেশি নাজুক অর্থাৎ ঝুঁকির বিবেচনায় রেড জোনে অর্থাৎ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ১০টি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ঋণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা, সম্পত্তির ঝুঁকি ও তারল্য সঙ্কটে দুরবস্থায় রয়েছে ‘রেড’ জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণ বিতরণে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না এসব প্রতিষ্ঠান। অনেকে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ করেছে বেশি। ক্যাশ ফো বা পরিচালন নগদ প্রবাহও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। ফলে আমানতের টাকা সময়মতো গ্রাহককে ফেরতও দিতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের অনুসন্ধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিলায়ান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি (বর্তমানে বিদেশে পালাতক) প্রশান্ত হালদারের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে।
বিভিন্ন লিজিং ও ব্যাংক থেকে এ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে। বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে কলমানির মাধ্যমে ধার নিয়েছে। কিন্তু ওই অর্থ এখন আর ফেরত দিতে পারছে না। বিশেষ করে পিপলস লিজিং অবসায়নের পর বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকগুলোকে কলমানির মাধ্যমে ধার দিচ্ছে না। ওই সূত্র জানিয়েছে, ফাস্ট ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, পিপলস লিজিংসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ব্যক্তি পর্যায়ে বড় অঙ্কের আমানত এবং প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ফেরত দিতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বেশির ভাগ েেত্র নতুন আমানত না পাওয়ায় এর কোনো সুরাহা করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এর ফলে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় গত সেপ্টেম্বরে ৩৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৫টিরই আমানত কমে গেছে। এটা এ খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আমানতকারী টাকার নিরাপত্তার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখে। তারা যদি গ্রাহকের সেই অর্থ সঠিক সময়ে ফেরত না দেয় তাহলে তারা কোথায় যাবে? এটি খুবই ভয়ঙ্কর অবস্থা। ব্যাংকগুলোর মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। তারা এক দিকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে, অন্য দিকে ঋণ বিতরণে কোনো যাচাই-বাছাই করছে না। ফলে ত্রুটিপূর্ণ ঋণ আর ফেরত আসছে না। এতে নগদ অর্থ সঙ্কটে পড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি বর্তমানের এ সঙ্কটের কথা স্বীকার করে জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে চলতি, সঞ্চয়ী, মেয়াদিসহ সব ধরনের আমানত নিতে পারে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তিন মাসের কম মেয়াদে কোনো আমানত নিতে পারে না। পরিচিতি কম থাকায় উচ্চ সুদ দিয়েও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত পেতে হিমশিম খেতে হয়। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়, যার বড় অংশ আসে ব্যাংক থেকে। তবে এখন ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটের কারণে নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাচ্ছে না।
এর প্রভাবে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান আগের নেয়া আমানতও ফেরত দিতে পারছে না। সব মিলে পুরো আর্থিক খাতের ওপরই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটা উত্তরণের একমাত্র পথ গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ উদ্ধারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। একই সাথে যারা জালজালিয়াতির সাথে জড়িত আছেন, তারা যেই হোন না কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারলে পুরো খাতের শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে মনে করেন ওই এমডি।
শেয়ারবার্তা / আনিস