ভূয়া নিরীক্ষকের নিরীক্ষা দিয়ে পুঁজিবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে মিরা অ্যাগ্রো ইনপুটস। কোম্পানিটি ইস্যু ম্যানেজার এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সহযোগিতায় পুঁজিবাজার থেকে ৫ কোটি টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করে। তবে ডিএসই তদন্তে ভূয়া নিরীক্ষার বিষয়টি উঠে আসার পরে পিছু হটেছে মিরা অ্যাগ্রো।
মিরা অ্যাগ্রো ইনপুটস ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯) আর্থিক হিসাব দিয়ে পুঁজিবাজার থেকে ৫ কোটি টাকা উত্তোলনের আবেদন করে। যে আর্থিক হিসাব ‘পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানি’ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষার কথা জানানো হয় ড্রাফট প্রসপেক্টাসে। কিন্তু ডিএসইর তদন্তে মিরা অ্যাগ্রোর আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা করেনি বলে জানিয়েছে পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানি।
এমন প্রতারনার দায়ে ইস্যু ম্যানেজারসহ মিরা অ্যাগ্রোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা ভাবছে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ। সম্প্রতি আয়োজিত এক পর্ষদ সভায় মিরা অ্যাগ্রোর ভূয়া নিরীক্ষা নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরী হয়। নিরীক্ষকের উপরে আস্থা রেখে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করলেও তারাই প্রতারণার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বলে সভায় অনেকে অভিযোগ করে।এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে ভবিষ্যতে কঠোর ভূমিকা পালন করবে ডিএসই। আর মিরা অ্যাগ্রো ও তার ইস্যু ম্যানেজারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) বিষদভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ওই সভায়।
ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) চেয়ারম্যান সি.কিউ.কে মোস্তাক আহমেদ বলেন, সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) এফআরসির কাউন্সিল মিটিংয়ে পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানির সাবেক পার্টনার নারায়ণ রায়ের মিরা অ্যাগ্রোর আর্থিক হিসাব নিরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় আইসিএবি সভাপতি জানিয়েছেন, নারায়ণ রায় নিরীক্ষা কার্যক্রম করার কথা না। সে এখন নিরীক্ষা কাজে নিষিদ্ধ এবং আপিলের সমাধান হয়নি। তারপরেও আমরা আইসিএবি সভাপতিকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।
গত ২১ জানুয়ারি নিরীক্ষার সত্যতা জানতে চেয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষ পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানিকে চিঠি দেয়। এর প্রতিত্তোরে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গত ২৮ জানুয়ারি ডিএসইকে জানায়, তারা মিরা অ্যাগ্রোর আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা করেনি। ডিএসইর এজিএম মো. আব্দুল লতিফকে লেখা চিঠিতে সাক্ষর করেছেন পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার পিনাকি দাস।
চিঠিতে পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানি জানিয়েছে, মিরা অ্যাগ্রোর ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের আর্থিক হিসাব আমাদের ফার্ম দ্ধারা নিরীক্ষা করা হয়নি। এ কোম্পানিটির আর্থিক হিসাব নিরীক্ষায় সাবেক চট্টগ্রাম অফিসের পেড ব্যবহার ও সাবেক পার্টনার নারায়ণ রায় সাক্ষর করেছে। যে শাখাটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যায় এবং আইসিএবির নির্দেশনায় ওই শাখাটির দায়িত্বরত পার্টনার নারায়ণ রায়কে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানি থেকে স্তফা দেওয়া হয়। ফলে নারায়ণ রায় ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বরের পরে পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানির নামে নিরীক্ষা কাজ করতে পারেন না। যা করলে আইসিএবির নির্দেশনা ভঙ্গ হবে।
চিঠিতে আরও জানানো হয়েছে, নারায়ণ রায়ের নিরীক্ষার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানাচ্ছি। এ বিষয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষও নারায়ণ রায়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এবং আইসিএবিকে অবহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পিনাকির এই চিঠির জবাব চেয়ে ইস্যু ম্যানেজার এএএ ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট গত ২৯ জানুয়ারি চিঠি দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এরপরের দিন অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি মিরা অ্যাগ্রোর ফাইল প্রত্যাহর করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই ও আইসিএবিকে চিঠি দেয় ইস্যু ম্যানেজার।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, অতালিকাভুক্ত হওয়ায় মিরা অ্যাগ্রো কমিশনের আইনের আওতায় নেই। তাই নিরীক্ষা নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে জনবলের অভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ে কাজ করতেই কমিশনকে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে অতালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ে কাজ করার সুযোগ কোথায়।
এ বিষয়ে ইস্যু ম্যানেজার এএএ ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান বলেন, নারায়ণ রায় পিনাকি অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার না থাকার বিষয়টি জানার সুযোগ ছিল না। নারায়ণ রায় এখনো মিরা অ্যাগ্রোর ন্যায় অসংখ্য কোম্পানির আর্থিক হিসাব পিনাকির নামে নিরীক্ষা করছে। এ নিয়ে আইসিএবি এবং পিনাকির কোন পদক্ষেপ নেই। কিন্তু আমরা পুঁজিবাজারে আসার জন্য ডিএসইতে ফাইল দাখিল করায় তা উম্মোচন হয়েছে। তবে সম্প্রতি বিএসইসি প্যানেল নিরীক্ষা ফার্মের নামের পাশাপাশি পার্টনারের তালিকা প্রকাশ করায়, সামনে এমনটি হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে ভূয়া নিরীক্ষক দিয়ে নিরীক্ষার দায় এড়াতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই পারি। নিরীক্ষক ইস্যু ম্যানেজার নিয়োগ দেয় না। এটা কোম্পানি নিয়োগ দেয়। আর ওই নিরীক্ষকের নিরীক্ষার উপরে আমরা কাজ করি।
মিরা অ্যাগ্রোর ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম বলেন, নিরীক্ষকের বিষয়টি যাছাই করা সুযোগ ছিল না। এছাড়া মিরা অ্যাগ্রো একটি ছোট প্রতিষ্ঠান। তবে ডিএসইর তদন্তের মাধ্যমে নিরীক্ষক নারায়ণ রায়ের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কোম্পানির ফান্ড উত্তোলনের ফাইল প্রত্যাহার করে নিয়েছি।
গত ২৪ ডিসেম্বর ডিএসইর এসএমই প্লাটফর্মে তালিকাভুক্তির জন্য প্রথম কোম্পানি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রসপেক্টাস জমা দেয় মিরা অ্যাগ্রো। এরপরে ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রসপেক্টাস জমা দেয়। যা যাছাই-বাছাই শেষে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ৫ কোটি টাকা উত্তোলন করার কথা ছিল।
শেয়ারবার্তা/ সাইফুল