রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের (ইএলবিএল) প্রতি বছরে কমছে উৎপাদন ও বাজার অংশীদারিত্ব। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে ইএলবিএলের ব্লেন্ডিংয়ের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৮৭৮ টন। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন এসে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৬২ মেট্রিক টন। অথচ অর্থাৎ ২২ বছরে বিক্রি কমেছে প্রায় ৯৪ শতাংশেরও বেশি।
যদিও এ সময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার অংশীদারিত্ব বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে কমছে বেইস অয়েল ও ব্যাটারি বিক্রি। এতে কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন বিনিয়োগকারীরা।
বিপিসির হিসাবে, বর্তমানে দেশে লুব্রিক্যান্টসের বাজার এক লাখ ৮০ হাজার টন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ আসে আমদানি করা ফিনিশড লুব প্রোডাক্টস লুব্রিক্যান্ট ও ৪০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে লুব্রিক্যান্টস উৎপাদনের মাধ্যমে। এ খাতে দেশে সক্রিয় আছে সরকারি ও বেসরকারি প্রায় ৫০ প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় বাজার অনেক ছোট। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে বেইজ অয়েলের দুষ্প্রাপ্ততার কারণে সংকুচিত হচ্ছে এ ব্যবসা।
বিপিসির ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের প্রতি বছর কমছে বাজার অংশীদারিত্ব। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্লেন্ডিংয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র এক হাজার ৩৬২ টন। অথচ কোম্পানিটির উৎপাদন সক্ষমতা আছে ২৪ হাজার টন। অপরদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে এ খাতের ৯৯ শতাংশ বাজার।
এদিকে ব্লেন্ডিং ব্যবসায় ভালো করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর আগে বেইস অয়েল ট্রেডিং ও ইউয়াসা ব্র্যান্ডের ব্যাটারি বিপণনে নজর দেয়। এতে শুরুর দিকে সাফল্য পেলেও গত অর্থবছরের বেইজ অয়েল চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি কমেছে ৪২ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের বিক্রি ছিল এক হাজার ৫০০ টন, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৯২২ টন। একই অর্থবছরে ব্যাটারি বিক্রির হার কমেছে আগের বছরের তুলনায় ২২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেছে মাত্র দুই কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যা আগের বছরে ছিল তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এদিকে পুঁজিবাজার ডিএসই’র লেনদেনচিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরে ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের শেয়ারের সর্বনিম্ন শেয়ারদর ছিল ৭৯৫ টাকা ৪০ পয়সা ও সর্বোচ্চ ছিল এক হাজার ৭৭০ টাকা। বর্তমানে এ শেয়ারের বাজারমূল্য ৯৩৮ টাকা; অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৮২৮ টাকা। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা গত এক বছরে শেয়ারের মূলধন লোকসান করেছে ৪০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। গত রোববার ২০২ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির ২,০৩০ শেয়ার লেনদেন করেন। এ সময়ে সর্বনিম্ন শেয়ারদর ছিল ৯৩৫ টাকা ৪০ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ছিল ৯৫৬ টাকা।
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, বাংলাদেশের যানবাহনে লুব্রিক্যান্ট অংশের ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। আর অনেকগুলো লুব্রিক্যান্ট প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারক রয়েছে এ দেশে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান যানবাহনশিল্প। প্রতিদিন আরও বেশি করে গাড়ি নামছে সড়কগুলোয়। স্বাভাবিকভাবেই এ খাতে লুব্রিক্যান্ট চাহিদা থাকবে ঊর্ধ্বমুখী এবং তা অব্যাহত থাকবে। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে মোট লুব্রিক্যান্টের ৭০ শতাংশ ব্যবহ্নত হয় অটোমটিভ খাতে। বাকি ৩০ শতাংশ হয় শিল্প খাতে। তবে বিগত কয়েক বছরে লুব্রিক্যান্ট বাজারের সম্প্রসারণ ঘটেছে বিশেষত বিদ্যুৎ খাতের সম্প্রসারণের কারণে। পাশাপাশি সিমেন্ট, ইস্পাত ও সারশিল্প খাতেও। আগামী দিনে শিল্প খাতে লুব্রিক্যান্টের ব্যবহার আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে; যেহেতু নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্প-কারখানাগুলো উৎপাদনে আসবে। এ কারণে অনেকগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর আগে থেকে সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে। এক্ষেত্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা। তারা বাজার সম্প্রসারণে কাজ করেনি। উল্টো ব্যাংক সুদে মুনাফায় মনোযোগী ছিল।
বিপিসি’র একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলোরই সুযোগ ছিল তেল আমদানি, ব্লেন্ডিং ও বাজারজাতকরণে। ওই সময়ে ৬৫ শতাংশের বেশি লুব অয়েলে কোনো অ্যাডিটিভ থাকত না। বাজার উদারীকরণের মাধ্যমে ন্যূনতম মানদণ্ড বজায় রাখার লক্ষ্যে ২০০১ সালে নন-অ্যাডিটিভ লুব্রিক্যান্টের আমদানি নিষিদ্ধ করে সরকার। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বহুজাতিক কোম্পানিসহ লুব্রিক্যান্টের ৫০টির বেশি ব্র্যান্ড প্রবেশ করেছে বাজারে। তাদের দাপটে ধীরে বাজারে অংশীদারিত্ব কমেছে ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের। এছাড়া প্ল্যাট আধুনিকায়ন না করা এবং বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে।
ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপিসির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহিদুল আলম শেয়ার, লুব্রিক্যান্ট পণ্য ও লুব বেইস অয়েল আমদানি এবং উৎপাদনের ব্যবসাগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ায় এ ব্যবসায় আমাদের বাজার অংশীদারিত্ব কমছে। পাশাপাশি আমাদের বিপণন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার অসহযোগিতার কারণে গত বছরের বিক্রি অনেক কমেছে। এছাড়া এ কোম্পানির তো নিজস্ব জনবলও নেই। পদ্মা অয়েলের কিছু লোকজন দিয়ে এ কোম্পানির কাজ চলে। আর বছরে লাভ হয় মাত্র এক কোটি টাকা। ফলে প্রচার-প্রচারণায় ব্যয় করার মতো সক্ষমতা নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ব্যাটারি অনেক ভালো হলেও দাম বেশি হওয়ায় বিক্রি কম হচ্ছে। তবে আশা কথা, লুব্রিক্যান্ট বিক্রিতে র্যাংগসের সঙ্গে চুক্তি করছি। এছাড়া যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছি। আশা করি আগামী বছরে ভালো পরিবর্তন আসবে।’
উল্লেখ্য, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেড দেশের সবচেয়ে বড় লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডিং প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পরের মালিকানা বদল হয়ে এটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আর ১৯৭৬ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠানটির ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকার, ২২ দশমিক ৮১ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং বাকি ২৬ দশমিক ২৬ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীর।
শেয়ারবার্তা / হামিদ