দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বাজেটের অন্যান্য খরচ মেটাতে গত এক দশকে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার যে প্রবণতা দেখা গেছে, সঞ্চয়পত্ত্রে বিক্রি কমে আসায় এখন তার উল্টো চিত্র দেখতে হচ্ছে সরকারকে।
গত ডিসেম্বরে যে টাকার সঞ্চয়পত্র সরকার বিক্রি করেছে, তার চেয়ে ৪০৮ কোটি ৪৪ টাকা বেশি খরচ হয়েছে সুদ-আসল পরিশোধে। অথচ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেও সুদ-আসল পরিশোধের পর সরকারের কোষাগারে ৩ হাজার ৩৩১ কোটি ৬১ লাখ টাকা জমা ছিল, যাকে বলা হয় নিট বিক্রি।
অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বলছেন, এতদিন বেশি সুদে ঢালাও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করার ‘মাশুল’ এখন দিতে হচ্ছে সরকারকে।
ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে গত কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
বিক্রির চাপ কমাতে ১ জুলাই থেকে মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একইসঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে কমতে শুরু করে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি। কিন্তু আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল ঠিকই শোধ করতে হচ্ছে। আর তার পরিমাণ বিক্রির অংককে ছাপিয়ে গেছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ডিসেম্বরে মোট ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধ করতে গিয়েই সরকারের ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে সরকার ব্যাংক থেকে ধার করে অর্থ সংস্থানে জোর দেওয়ায় এরকম একটি পরিস্থিতি যে হতে পারে, তা একরকম অনুমিতই ছিল। তবে রাজস্ব আদায়ের নাজুক পরিস্থিতির কারণে এই প্রবণতা উদ্বেগ জাগাচ্ছে অর্থনীতিবিদদের মনে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলছেন, ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ প্রবাদটিই এখন তার মনে পড়ে যাচ্ছে।
“রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কার কারণে বাধ্য হয়ে সরকারকে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করতে হচ্ছে। যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে সরকার এতদিন প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতো, সেই সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে এখন ব্যাংকের ঋণের টাকায়।”
অবশ্য সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর কোনো বিকল্পও সরকারের সামনে ছিল না বলে মনে করছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত। তিনি বলেন, এটা এখন না করলে সরকারের ভবিষৎ ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যেত; তখন সংকট আরও বাড়ত।
তিনি আরো বলেন, মুনাফা বেশি বলে ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ হিসেবে পরিচিত সঞ্চয়পত্র খাতে সবাই এতদিন বিনিয়োগ করেছে। ঢালাও সুবিধা দেওয়ার কারণে যাদের এ সুযোগ পাওয়ার কথা নয় তারাও নিয়েছেন।
“এখন কড়াকড়ির কারণে বিক্রি কমে গেছে; কিন্তু আগের সুদ-আসল ঠিকই শোধ করতে হচ্ছে। তবে এখানে একটা সুবিধা হচ্ছে, সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে ঋণ নিচ্ছে তার বেশিরভাগই ট্রেজারি বন্ডের বিপরীতে। তাতে বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হচ্ছে না।”
জায়েদ বখত মনে করেন, দেশের অর্থনীতিকে স্বস্তিতে রাখতে চাইলে সরকারকে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। এখানে বড় ঘাটতি থাকলে সব জায়গাতেই সমস্যা থেকে যাবে।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ঠিক করেছিল সরকার। এর মধ্যে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৫ হাজার ৪৩৩ কোটি ২১ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।
পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখতে গেলে বাকি ছয় মাসে ( জানুয়ারি-জুন) এই খাত থেকে ২১ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা টাকা ঋণ নিতে হবে। কিন্তু বিক্রি যেভাবে কমছে, তাতে সেটা হবে না বলেই মনে করছেন জায়েদ বখত।
সেক্ষেত্রে বাজেটের অর্থ যোগাতে সরকারকে ব্যাংক থেকে আরও বেশি ঋণ নিতে হবে অথবা সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আবার বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ দুই ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য আনতে না পারলে কাঁচি চালাতে হবে বাজেটে।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৩৪ হাজার ২১১ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের ২৮ হাজার ৭৭৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। সে হিসেবেই এই ছয় মাসে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৩৩ কোটি ২১ লাখ টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। ওই সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব আদায়ের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় জুলাই-অক্টোবর সময়ে লক্ষ্যের চেয়ে ৩১ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
এতোদিন সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করে সরকার প্রয়োজনীয় খরচ মেটাত। কিন্তু এখন বিক্রি কমায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু সাড়ে ছয় মাসেই ( ১ জুলাই থেকে ১৫ জানুয়ারি) সেটা ছাড়িয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
শেয়ারবার্তা/ আনিস