বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের কর্মকাণ্ড তদারকিতে ২০১৭ সালে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই টাস্কফোর্সের কার্যক্রম না থাকার কারণে বিদেশিদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।
এ কারণে দেশে অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা বিপুল অর্থ দেশে নিয়ে গেলেও তাদের ওপর সরকারের নজরদারি নেই। বিদেশি কর্মীদের কাজের অনুমতি দেওয়া এবং তাদের কাছ থেকে কর আদায়ে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। ফলে দেশ থেকে অবৈধপথে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে।
জানা যায়, বর্তমানে পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), এনজিও ব্যুরোসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের নিয়ে কাজ করলেও সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।
বিদেশিরা বাংলাদেশে চাকরি করে অনিয়মের মাধ্যমে বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে বলে টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, দেশে দক্ষ লোক পাওয়া গেলে কেউই বিদেশি লোক নেবে না। নিশ্চয় কোথাও ঘাটতি আছে বলেই বিদেশিরা কাজের সুযোগ পাচ্ছে। তবে এটা আস্তে আস্তে কমছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমারও একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। যেখানে এক সময় ১৪ জন বিদেশি লোক কাজ করত। এখন মাত্র ৪ জন কাজ করছে। এরকমভাবে কমে আসছে। যখন দেশের লোকেরা সক্ষম হবে, তখন আর এত টাকা বেতন দিয়ে কেউ বিদেশি লোক রাখবে না।’
তিনি বলেন, বিদেশি কর্মীদের বড় অংশ কর দেয় না। কর দিলে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আসত। বিদেশি কর্মী যদি রাখতেই হয়, তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিদেশি কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে হবে। বিদেশি কর্মীরা যাতে কর পরিশোধ করে সেজন্য রাজস্ব বিভাগকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নিজস্ব কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়িয়ে দেশের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টাও থাকতে হবে। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা বাড়ার পেছনে প্রধান সমস্যা হচ্ছে প্রশাসনিক অদক্ষতা। সরকার এখনও সঠিকভাবে জানেই না, কতজন অবৈধ বিদেশি কাজ করছে, তারা কী করছে, কোথায় কাজ করছে। ফলে একদিকে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, অন্যদিকে তারা মাদক, চোরাচালান ও জাল মুদ্রা ব্যবসার মতো নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। এ জন্য তাদের ধরতে এখনই কঠোর আইন করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
টিআইবি বলেছে, বাংলাদেশে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এর মধ্যে অবৈধ এক লাখ ষাট হাজার। তারা পর্যটন ভিসায় এসে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই চাকরি করছেন। তাদের আয় গোপন থাকায় বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দেওয়া হয়।
জানা যায়, বিদেশিদের বেশিরভাগই প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা থেকে এসেছেন। তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বায়িং হাউসে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে দেশে নিয়ে যাচ্ছেন ৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, অবৈধ কর্মীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর কারণে দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। তাদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় পাচার রোধ করা যাবে না। এ জন্য বিদেশি কত আছে তার পরিসংখ্যান বের করতে হবে। একইসঙ্গে যে সব প্রতিষ্ঠান অবৈধ কর্মীদের নিয়োগ দিচ্ছে তাদেরও শনাক্ত করতে হবে। এজন্য কঠোর নজরদারি ও নীতিমালা দরকার। তিনি আরও বলেন, নিয়ম এমনভাবে করতে হবে যে বাংলাদেশি দক্ষ কর্মী পাওয়া গেলে বিদেশি নিয়োগ করা যাবে না।
অর্থনীতিবিদ ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, কাজের বিনিময়ে অর্থ অর্জন করা তো আইনেই আছে। সমস্যা অন্য জায়গায়। কাজ করতে যে অনুমতি দরকার তা নেই। এ কারণে বিদেশিরা অবৈধ হয়ে পড়ছে। এটা অর্থনীতির সমস্যা নয়। এজন্য প্রধানত দায়ী প্রশাসনিক সমস্যা। অবৈধ হলে গ্রেপ্তার করে প্রচলিত আইনে শাস্তি দিতে হবে। এখানে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা আছে। অভাব আছে তদারকির। এসব বিষয়ে সরকারকে এখনই নজর দিয়ে কঠোর আইন করার তাগিদ দেন তিনি।
পুলিশের ইমগ্রেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি নাগরিকদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণে আলাদা ইউনিট আছে। এখান থেকে নিয়মিত মনিটর করা হয়। মনিটর করলে এত বিপুল সংখ্যক বিদেশি কীভাবে দেশে অবৈধভাবে কাজ করছে তার কোনো উত্তর মেলেনি।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, আইন প্রয়োগের সমস্যা আছে। নজরদারি খুবই দুর্বল। কে কোথায় কাজ করছে সরকারের কোনো সংস্থার কাছে রেকর্ড নেই। তিনি আরও বলেন, দেশে দক্ষ জনবলের অভাব একটি বড় সমস্যা। সে জন্য বাধ্য হয়ে বেশি বেতন দিয়ে বিদেশিদের রাখা হয়। আমাদের দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। তা হলে বিদেশি কর্মী নিয়োগে নির্ভরশীলতা কমবে।
তিনি মনে করেন, ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। যারা দেবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ বিদেশির ওয়ার্ক পারমিট নেই। কেউ কেউ চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করে বিপুল আয় করলেও ঠিকমতো কর দিচ্ছেন না সরকারকে।
এনবিআর সূত্র বলছে, ওয়ার্ক পারমিট না থাকার কারণে করের আওতায় আনা যাচ্ছে না তাদের। ফলে কর ফাঁকির মাধ্যমে এ খাত থেকে বছরে বিপুল অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং হচ্ছে। বিদেশিদের অর্জিত আয়ের ওপর করহার মোট আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ। সাধারণত নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কর পরিশোধ করে থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার বিদেশি নিয়মিতভাবে আয়কর রিটার্ন জমা দেন। তাদের বেশিরভাগ তৈরি পোশাক খাত ও রেস্টুরেন্টে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।
বিডা সূত্র জানায়, সরকারের সংশ্নিষ্ট সংস্থার অনুমোদন ছাড়া স্থানীয় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ী গ্রুপ সরাসরি বিদেশিদের চাকরিতে নিয়োগ দিলে তা হবে অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনে এজন্য জেল-জরিমানার বিধান থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই।
জানা যায়, স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের তিনটি দায়িত্বশীল সংস্থা রয়েছে। এগুলো হলো- বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) এবং এনজিও ব্যুরো। পোশাক, বস্ত্র, চামড়াসহ বেসরকারি বিভিন্ন শিল্প খাতে বিদেশিদের চাকরিতে নিয়োগের বিষয়ে ওয়ার্ক পারমিটের অনুমতি দেয় বিডা। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের অনুমতি দেয় বেপজা। বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে এনজিও ব্যুরোর অনুমতি লাগে। সবচেয়ে বেশি ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে বিডা। বিডা কর্তৃপক্ষ বলেছে, অবৈধ বিদেশি কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কে দেশে আসছেন, আর যাচ্ছেন সব তথ্য পুলিশের সংশ্নিষ্ট বিভাগের কাছে রয়েছে। তারা ঠিকমতো তদারকি করলে অবৈধ বিদেশিদের সহজেই ধরা যাবে।
বিডার এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশিদের কত বেতন দিতে হবে, দেশভেদে তার একটা সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া রয়েছে। কিন্তু দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা সীমার চেয়ে আরও অনেক বেশি বেতন দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এনজিও ব্যুরো সূত্র বলেছে, অনেক সংস্থায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশিরা কাজ করেন। এ জন্য অনুমতি নিতে হয়। চুক্তি অনুযায়ী, তাদের নিয়োগ দেয় সংশ্নিষ্ট এনজিও। কেউ কেউ প্রকল্পের মেয়াদকাল পর্যন্ত কাজ করেন। সাধারণত দাতাদের সহায়তায় পরিচালিত এনজিওগুলোতে বেশি বিদেশি কাজ করেন।
শেয়ারবার্তা / আনিস