দেশের ৬১টি সংস্থার তহবিলে বিপুল পরিমাণ উদ্ধৃত্ত অর্থ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সরকা প্রাথমিকভাবে ৩১ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছে। এ লক্ষে সরকারি কোষাগারে জমা বা স্থান্তরের বিধান নতুন আইন নামে একটি বিল সংসদে পাশ হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত সংস্থাগুলোর কাছে ২ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা জমা রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ বিভাগকে জানিয়েছিল।
আইনটিকে নজিরবিহীন, কালো আইন ও জনস্বার্থ বিরোধী হিসেবে অবিহিত করে সংসদের বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং বিলটি পাস না করে প্রত্যাহারের দাবি জানান। এমনকি প্রতিবাদ হিসেবে বিলের ওপর আনা দফাওয়ারি প্রস্তাবগুলো উত্থাপন থেকে বিরত থাকেন তারা।
বিরোধীদলীয় সদস্যরা বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিলটি পাস করা হলে খারাপ নজির হয়ে থাকবে। তারপরও বিলটি পাস করার প্রস্তাব করা হলে তারা ওয়াক আউট করেন। ‘স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন ফাইন্যান্সিয়াল কর্পোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাসমুহের উদ্ধৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০২০’ শীর্ষক বিলটি সংসদে পাস হয়।
বুধবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সভাপতিত্বে একাদশ সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশেন বৈঠকে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। এর আগে বিলের ওপর আনীত জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা বিলটির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিলটি পাস না করার দাবি জানান। একইসঙ্গে বিলটিকে আইন ও গণবিরোধী হিসেবে উল্লেখ করে বিলটির প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানান। পরে কণ্ঠভোটে এসব দাবি প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়ে যায়। একইভাবে সংশোধনী প্রস্তাবসমুহ উত্থাপন করতে দাঁড়িয়ে বিরোধীদলীয় এমপিরা বিলটিকে কালো আইন ও ন্যাক্কারজনক হওয়ার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ হিসেবে বিলের ওপর আনা দফাওয়ারি প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করা থেকে বিরত থাকেন।
অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বক্তাদের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে এই আইনের উপকারিতা দেখার জন্য ছয় মাস সময় প্রার্থনা করেন। ফলে সংশোধনীগুলো উত্থাপিত হয়নি বলে ভোট দেওয়া হয়নি। পরে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। এসময় বিরোধী দলের সদস্যরা ওয়াক আউট করেন।
বিলটির ওপর জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনীর প্রস্তাব আনেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক, ডা. রুস্তম আলী ফরাজী, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, নাজমা আক্তার, বিএনপির হারুনুর রশীদ ও ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, গণফোরামের মোকাব্বির খান।
এর আগে বিলটির বিরোধীতা করে বক্তরা বলেন, ব্যাংক থেকে সরকার টাকা ধার নিয়ে ব্যাংককে খালি করে ফেলা হয়েছে। দেশ থেকে টাক পাচার হয়ে গেছে, অর্থমন্ত্রী কোনো টাকা উদ্ধার করতে পারেননি। অর্থবাজারে ধস নেমেছে। ৪৮ হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়ে গেছে। কোথাও টাকা নেই। ৩৬ হাজার কোটি টাক রাজস্ব আয় করতে না পেরে তিনি এখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের দিকে নজর দিয়েছেন। কিন্তু আইনত পাবলিক মানিতে তিনি কোনো সময়ই হাত দিতে পারবেন না। এটা করলে পলিটিকালী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী জানান, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটাতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব সংস্থা সমূহের অনুকূলে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা পড়ে আছে, যা জনগণের ব্যবহার করা সমীচীন। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের সংস্থান প্রয়োজন; যা বর্তমান সংগৃহিত রাজস্ব দ্বারা মেটানো দূরূহ হওয়ায় সংস্থা সমূহের তহবিলে রক্ষিত উদ্ধৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের মাধ্যমে বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত উন্নত দেশ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই বিলটি আনা হয়েছে।
বিলের বিধান অনুযায়ী সংস্থার বাৎসরিক পরিচালনা ব্যয়, নিজস্ব অর্থায়নে অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাৎসরিক ব্যয় নির্বাহের অর্থ, আপদকালীন ব্যয়ের জন্য বাৎসরিক পরিচালনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থের অতিরিক্ত উদ্ধৃত্ব অর্থ প্রতি অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।
বিলে ৯টি ধারা ও একটি তফসিল রয়েছে। তফসিলে ৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়ে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তবে তফসিল সংশোধনেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, জাতীয় ক্যারিকুলাম এবং টেক্সবুক বোর্ড, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও দিনাজপুর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড), পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বগুড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক), জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ), বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ, রাজশাহী), বাংলাদেশ রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ টেক্সাইল মিলস কর্পোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, প্রেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিআরসি), বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ চা বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউউটিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসা, ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তপক্ষ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও বাংলাদেশ টেলি রেগুলেটরি কমিশন।
কোন সংস্থা তহবিলে রক্ষিত অর্থ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান না করলে সরকার উক্ত সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধি বিধান অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারবে মর্মে বিলের ধারা-৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে। বিলের ধারা-৩ এ বলা হয়েছে তফসিলভুক্ত সংস্থা সমূহের উদ্ধৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমার ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানই প্রাধান্য পাবে। কোনো সংস্থা এই আইনের কোনো বিধানকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করলে তা অকার্যকর মর্মে গণ্য হবে। আইনের বিধানের অস্পষ্টতার কারণে তা কার্যকরে কোনো অনুসুবিধা দেখা দিলে সরকার অন্যান্য বিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা উক্ত বিধানের স্পষ্টীকরণ বা ব্যাখ্যা প্রদান করে করনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করতে পারবে।
শেয়ারবার্তা / আনিস