পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দেশের বহুজাতিক মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন রাষ্ট্রীয় পাওনা পরিশোধ না করলে নতুন সিমের অনুমতিসহ নতুন অফার, বন্ধ থাকা পুরোনো সিম রিপ্লেসমেন্ট ও প্রমোশনসহ যাবতীয় নতুন কোনো কার্যক্রমের অনুমতি দেবে না বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
বিটিআরসির এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে গ্রামীণফোনের সিম সংকট ও নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে অনুমতি না পেলে গ্রাহকদের সেবার মান খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে গ্রামীণফোনের ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি থমকে যেতে পারে।
গ্রামীণফোনের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০১৯ সালে ১৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে গ্রামীণফোন, যা আগের বছরের তুলনায় আট দশমিক এক শতাংশ বেশি। তবে এ সময় কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা কিছুটা কমে গেছে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা হয়েছে তিন হাজার ৪৫০ কোটি টাকা; আগের বছর যার পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। তবে ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি থমকে গেলে মুনাফা আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
সর্বশেষ হিসাব মতে ২০১৯ সালের শেষে গ্রামীণফোনের গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত কোটি ৬৫ লাখ। ২০১৮ সালের শেষে এ সংখ্যা ছিল সাত কোটি ২৭ লাখ। কোম্পানিটির দৈনিক ৫০ হাজার সিমের চাহিদা রয়েছে। তবে বিটিআরসির অনুমোদন না পাওয়ায় সিম সংকটে গ্রাহক প্রবৃদ্ধিও থমকে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘গত ২৪ নভেম্বর ২০১৯ সালে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত রায়টি সদয় পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রামীণফোন চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে একটি রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছে। আবেদনে আমরা গ্রামীণফোনের কাছ থেকে বিটিআরসির ত্রুটিপূর্ণ অডিটের ভিত্তিতে দাবিকৃত মূল টাকার ২৫ শতাংশ বা প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকা ১২টি সমান মাসিক কিস্তিতে ডিপোজিট হিসেবে জমা দেওয়ার সুযোগ প্রদানের জন্য আবেদন করেছি।’
সিম সংকট নিয়ে গ্রামীণফোন জানায়, ‘আমাদের কাছে বিক্রির জন্য নতুন সংযোগের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। তারপরও আমাদের স্টক থাকা পর্যন্ত গ্রাহক চাইলে নতুন সংযোগ কিনতে পারবেন। তবে আমরা নিশ্চিত করছি যে, সিম রিপ্লেসমেন্টের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না।’
উল্লেখ্য, গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা বাবদ প্রায় ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির এনওসি দেওয়া বন্ধ রেখেছে বিটিআরসি। যদিও পাওনা বাবদ ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার মধ্যে ৫৭৫ কোটি টাকা ১২ কিস্তির সুবিধায় দিতে রাজি হয় গ্রামীণফোন।
জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ‘টাকা প্রদান করা পর্যন্ত গ্রামীণফোনের নতুন কোনো সিম, প্রমোশন বা অফারসহ যাবতীয় নতুন কোনো কার্যক্রমে বিটিআরসি অনুমতি দেবে না। মোট কথা, আইনে বিটিআরসির করণীয় কিছু নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাওনা পরিশোধে গ্রামীণফোনকে তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন আপিল বিভাগ, যা শেষ হবে ২৩ ফেব্রুয়ারি। এ সময়ের মধ্যে যদি আপিল বিভাগের কোনো সিদ্ধান্তে পরিবর্তন না আসে, তখন বিটিআরসি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। অর্থাৎ, ওই সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলেও সরকার প্রশাসক নিয়োগের মতো অবস্থানে যাবে।’
সম্প্রতি গ্রামীণফোন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রতিষ্ঠানটির নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজম আশা করেন, শিগগিরই গ্রামীণফোনের নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে থাকা জটিলতার সমাধান হবে।
মতবিনিময় সভায় ইয়াসির আজমান জানান, গ্রামীণফোনের যেসব সিম বাজারে রয়েছে, তা এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। ফলে বাজারে গ্রামীণফোনের সিম (০১৭ ও ০১৩ নম্বর সিরিজ) পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে কোনো সিম নেই। খুচরা বিক্রেতাদের হাতে কিছু রয়েছে। সেগুলো শেষ হয়ে গেলে বাজারে আর সিম পাওয়া যাবে না।’
সিম রিসাইকেলের (পুরোনো বন্ধ সিম নির্দিষ্ট সময় পর বিক্রির জন্য রেডি করা) জন্য বিটিআরসির অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। সিম রিসাইকেলের জন্য এরই মধ্যে ৩০ লাখ সিম জমা হয়েছে বলে জানান তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াসির আজম বলেন, সরকারের বকেয়া পাওনা নিয়ে গ্রামীণফোনের সঙ্গে যে সংকট চলছে, তাতে তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে দৃশ্যমান উন্নতি হবে।
উল্লেখ্য, গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তির দাবির প্রায় ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা আদায়ে কয়েক দফা চেষ্টা করে বিটিআরসি। তবে অর্থ পরিশোধে সায় দেয়নি গ্রামীণফোন। ফলে সে টাকা আদায়ে গত বছর জুলাইয়ে গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইডথ কমানো হয়। পরে তা প্রত্যাহার করে জুলাইয়ের শেষ দিকে সব ধরনের এনওসি প্রদান বন্ধ করা হয়। এতেও কোনো ফল না পাওয়ায় লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর গ্রামীণফোনকে নোটিস পাঠায় বিটিআরসি। ওই নোটিসে গ্রামীণফোনের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না, তা ৩০ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছিল।
এর আগে ২৫ আগস্ট বিটিআরসির দাবিকে অযৌক্তিক মনে করে নিম্ন আদালতে মামলা করে গ্রামীণফোন। এ মামলায় পাওনা দাবির অর্থ আদায়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চায় কোম্পানিটি। যদিও ২৮ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নামঞ্জুর করেন।
পরে বিষয়টি সমাধানে ৩ অক্টোবর গ্রামীণফোন, বিটিআরসি ও এনবিআরকে নিয়ে আলোচনায় বসেন অর্থমন্ত্রী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। সে মিটিংয়ে গ্রামীণফোনকে ৩৭ দিনের মধ্যে ২০০ কোটি টাকা দিতে প্রস্তাব করা হয়। প্রথম সপ্তাহে সাত দিনের মধ্যে ১০০ কোটি এবং পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আরও ১০০ কোটি টাকা দিতে প্রস্তাব করা হলেও সে প্রস্তাবেও সাড়া দেয়নি গ্রামীণফোন।
গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে কোনো অর্থ পরিশোধ না করায় গত ১৮ অক্টোবর কোম্পানিটিতে প্রশাসক বসানোর অনুমোদন দেয় সরকার। যদিও এর মাঝেই গ্রামীণফোন গত ১৬ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে আপিল করে। এর গ্রহণযোগ্যতার শুনানি নিয়ে ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন এবং ওই অর্থ আদায়ের ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন। তবে এ আদেশের বিরুদ্ধে গত ২৩ অক্টোবর আপিল করে বিটিআরসি, যা চেম্বার বিচারপতির আদালত হয়ে আপিল বিভাগে যায়।
গত ২৪ নভেম্বর বিটিআরসির প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার নিরীক্ষা দাবির নোটিসের ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে গ্রামীণফোনকে অবিলম্বে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আদেশে বলা হয়, গ্রামীণফোন ওই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাও বাতিল হয়ে যাবে। তখন গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে যে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। যদিও গত ১৯ ডিসেম্বর গ্রামীণফোনের মূল কোম্পানি টেলিনর রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিস দেয়। এক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না হলে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন আদালতে মামলা করার হুমকি দেওয়া হয়।
শেয়ারবার্তা / মিলন