দেশের আর্থিক খাতে লুণ্ঠনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত তিন নাম প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার), মো. আবদুল আজিজ ও আবদুল হাই বাচ্চু। দেশের উৎকৃষ্ট ব্যাংকের স্বীকৃতি থাকা বেসিক ব্যাংককে একাই ধসিয়ে দিয়েছেন আবদুল হাই বাচ্চু। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ। আর পুঁজিবাজার এবং চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে (এনবিএফআই) সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে নিয়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও অনুসন্ধান চলমান রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে দুজনের বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা।
ব্যাংক লোপাটের এই তিন কারিগরের কে কোথায় আছেন, তা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিকে হালদার এখন কানাডায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন। একই দেশে রাজার হালে আছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজও। আর বেসিক ব্যাংক চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় নেয়ার পর নিউইয়র্ক-লন্ডনে সপরিবার আনন্দ-উল্লাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আবদুল হাই বাচ্চু। যখন খুশি তখন দেশেও আসছেন তিনি।
দেশের আর্থিক খাতে পিকে হালদারের লুণ্ঠন পদ্ধতি যেকোনো থ্রিলার চলচ্চিত্রকে হার মানায়। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান দখলের চেয়েও রোমাঞ্চকর ছিল পিকে হালদারের বিদেশ যাত্রা। গ্রেফতার এড়াতে অবস্থান করছিলেন রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে। সেখান থেকে ছদ্ম বেশে বেরিয়ে কোনো বিমানবন্দরে যাননি। দেশ থেকে পালানোর জন্য যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরকেই ব্যবহার করেছেন তিনি।
পিকে হালদার দেশ থেকে পালিয়েছেন চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। যদিও গত বছরের অক্টোবর থেকেই তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল দুদক। দেশ ছাড়ার পর পিকে হালদারের গন্তব্য ছিল ভারত। সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করে পাড়ি দিয়েছেন কানাডার মন্ট্রিলে। সেখানে আবাসন ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আগে থেকেই কানাডার মন্ট্রিলে রুনা করপোরেশন নামের একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন পিকে হালদার। এছাড়া কানাডার টরন্টোতে পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামের একটি কোম্পানিও রয়েছে তার। ২০১৪ সালের ৩ জুলাই কানাডা বিজনেস করপোরেশন অ্যাক্টের অধীনে নিবন্ধিত কোম্পানিটির ঠিকানা দেয়া হয়েছে ১৬, ডিয়েনক্রেস্ট রোড, টরন্টো। প্রশান্ত কুমার হালদার ছাড়াও কোম্পানিটির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। কানাডা ছাড়াও ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বিপুল বিনিয়োগ আছে পিকে হালদারের। দেশের পুঁজিবাজার ও অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুণ্ঠিত অর্থই ওইসব দেশের পাচার ও বিনিয়োগ করেছেন তিনি।
আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বড় বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারির নেপথ্য নায়করা যখন খুশি তখন দেশ ছাড়ছেন। বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন বিশ্বের অভিজাত সব শহরে। বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আছে এমন ঋণখেলাপিদেরও ইমিগ্রেশনে আটকানো যাচ্ছে না। দেশের ব্যাংক লুটের কারিগরদের বিলাসী জীবন অন্যদেরও অনৈতিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করছে।
আর্থিক খাতের লুণ্ঠনকারীদের প্রতি উদারতা না দেখিয়ে কঠোর হস্তে দমন করা সময়ের দাবি বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে বৈধ-অবৈধ পন্থায় টাকা নিয়ে বিদেশে পালানোর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। লুটেরাদের পাসপোর্ট বাতিল করা দরকার। একই সঙ্গে এসব বড় অপরাধী যেসব দেশে অবস্থান করবে, সেসব দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। লুটেরাদের ভিসা বাতিল করা সম্ভব হলে তবেই দেশ থেকে পালানোর সংস্কৃতি রোধ হবে। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া দরকার।
পিকে হালদারের মতোই কানাডায় অবস্থান করছেন জনতা ব্যাংক লুণ্ঠনের আরেক নায়ক মো. আবদুল আজিজ। তবে মাঝেমধ্যেই দেশে আসছেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার এ কর্ণধার। দেশে এলে থাকছেন রাজধানীর ধানমন্ডির একটি অভিজাত ফ্ল্যাটে। যদিও বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আছে আবদুল আজিজের ক্ষেত্রেও।
আবদুল আজিজসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৯১৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের। দুদকের অভিযোগ ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের। আর জনতা ব্যাংকের অভিযোগ ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা ফেরত না দেয়ার।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেশের সব ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জাতীয় সংসদে ঘোষিত খেলাপি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ তিনটিই আবদুল আজিজ ও তার পরিবারের সদস্যদের। সে তালিকায় এক নম্বর স্থান পেয়েছে আবদুল আজিজের প্রতিষ্ঠান রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এছাড়া ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টের কাছে পাওনা ১ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। একই গ্রুপের রূপালী কম্পোজিটের কাছে ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা পাবে জনতা ব্যাংক। এছাড়া লেক্সকো লিমিটেডের কাছে ৫১৪ কোটি এবং ক্রিসেন্ট ট্যানারিজের কাছে ২৩১ কোটি টাকা পাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। সব মিলিয়ে আবদুল আজিজের পরিবারের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। ভুয়া রফতানিসহ নানা প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে এ অর্থ নিয়েছেন তারা।
ব্যাংক থেকে নেয়া অর্থের বড় অংশই বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধাররা। এ অর্থের একটি অংশ গিয়েছে কানাডায়। বর্তমানে আবদুল আজিজও কানাডায় অবস্থান করছেন।
সম্প্রতি আবদুল আজিজের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই কানাডায় এসেছি। আবার প্রয়োজন হলে দেশে যাই।’
বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও দুদকের ডাকে ছয়বার হাজিরা দিয়েছেন বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠনের ‘নায়ক’ আবদুল হাই বাচ্চু। ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের আদর্শ ব্যাংকের স্বীকৃতি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের। কিন্তু এর পরবর্তী পাঁচ বছরে পুরোপুরি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকটি। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু।
বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৬১টি মামলা করেছে দুদক। এসব মামলায় ব্যাংকটির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের আসামি করা হলেও অজ্ঞাত কারণে আসামি করা হয়নি পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের। তবে মামলা তদন্তের কথা বলে ২০১৭ সালের ৪ থেকে ২০১৮ সালের ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে ছয় দফায় আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তারপর থেকে বাচ্চুকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
বড় ঋণখেলাপিরা অবাঞ্ছিত না হয়ে উল্টো রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলে সম্প্রতিক সময়ে সরকার যতগুলো উদ্যোগ নিয়েছে, তার সবকটিই অকার্যকর শুধু নয় বরং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। খেলাপিদের পুনর্বাসিত করে কখনোই ব্যাংকিং খাতের রোগ সারানো সম্ভব হবে না। ব্যাংকের অর্থ লুটে অনেকেই দেশ ছাড়ছেন, কিন্তু তাদের ধরা হচ্ছে না। দেশ ছাড়তে গিয়ে বড় কোনো ঋণ খেলাপি গ্রেফতার হয়েছেন এমন একটি নজিরও নেই।
শেয়ারবার্তা / আনিস