বন্ড বাজারের বিকাশের লক্ষ্যে সব ধরনের বন্ডের ট্রাস্ট ডিড নিবন্ধন ফি প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে সরকার। এ ফি ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক এক শতাংশ (০.১%) নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বেঁধে দেওয়া হয়েছে নিবন্ধন ফি’র সর্বোচ্চ পরিমাণ। অবশেষে দেশের সম্ভাবনাময় বন্ড মার্কেটের জন্য এসেছে বহু প্রত্যাশিত সুখবর।
অভ্যন্তরীন সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বন্ডের ট্রাস্ট ডিড নিবন্ধন ফি’র নতুন হার নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বন্ড, ডিবেঞ্চার ও সুসুক (ইসলামী শরীয়াহসম্মত বন্ড) এর ক্ষেত্রে এই হার প্রযোজ্য হবে। ট্রাস্ট ডিড নিবন্ধন ফি কমানোর কারণে বন্ড ইস্যুর ব্যয় ব্যাপকভাবে কমে আসবে।
এতদিন ১০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করতে চাইলে তার জন্য ২ কোটি টাকা ট্রাস্ট ডিড নিবন্ধন ফি দিতে হতো। বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি ছিল বড় ধরনের চাপ। বন্ড জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি বড় বাধা।
নতুন ফি কার্যকর হওয়ার পর ১০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করতে মাত্র ১০ লাখ টাকা ট্রাস্ট ডিড নিবন্ধন ফি দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, বন্ডের আকার যদি এরচেয়ে বেশিও হয়, তাহলেও নিবন্ধন বাড়বে না। কারণ যে কোনো পরিমাণ বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিবন্ধন ফি ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই নতুন ফি বন্ড ইস্যুকারীদের কাছে বেশ সহনীয় বিবেচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বন্ড, ডিবেঞ্চার ও সুকুক-তিনটিই মূলত ঋণপত্র। এই ঋণপত্র ইস্যু করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসার প্রয়োজনে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। বন্ড ও ডিবেঞ্চারধারীকে (সুকুক ব্যাতিত) একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করা হয়। আর সুকুকের ক্ষেত্রে দেওয়া হয় ব্যবসার মুনাফার একাংশ।
সুদ হারের সঙ্গে ২ শতাংশ নিবন্ধন ব্যয় যোগ করলে বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় দাঁড়ায় অনেক বেশি, যা ব্যবসার জন্য অনুকূল নয়। তাছাড়া এর চেয়ে কম হারে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তহবিল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তাই এতদিন পারত পক্ষে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ড ইস্যুর পথে হাঁটতো না।
অন্যদিকে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুদের হার কমিয়ে দিলে ওই বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারান বিনিয়োগকারীরা। কারণ স্বল্প সুদ হারের কারণে ওই বন্ড আর বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় থাকে না। ফলে বন্ডের ক্রেতা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।
নিবন্ধন ফি কমানোর কারণে সুদ হার না কমিয়েও বন্ডের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমানো সম্ভব হবে। এতে একদিকে বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের উপর চাপ পড়বে না। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের কাছেও প্রস্তাবিত সুদহার কিছুটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
দেশে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে উঠলে তা সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজারে বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ এর মধ্য দিয়ে বাজারে বৈচিত্র বাড়বে, বিনিয়োগের জন্য বিকল্প সুযোগ তৈরি হবে। যারা শেয়ারে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চান না, তারা কম ঝুঁকিপূর্ণ বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠায় বন্ড মার্কেট খুবই জরুরি। একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তোলার জন্য ট্রাস্ট ডিড নিবন্ধনের উচ্চ ফি কমানোসহ অন্যান্য বাঁধা দূর করতে দীর্ঘদিন ধরে তাগিদ দিয়ে আসছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসি’র পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিশ্বাব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সরকারকে শিল্পায়নে ব্যাংক নির্ভরতা কমাতে বন্ড মার্কেটের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জোরালোভাবে বলে আসছে। এর প্রেক্ষিতে গত বছর সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। আর ওই কমিটিও বন্ড বাজারের বিকাশের পথে উচ্চ নিবন্ধন ফি’কে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। কমিটি এই ফি কমানোর সুপারিশ করে। এ বিষয়টি বিশেষভাবে নজরে আনতে বিএসইসি থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ করতে থাকে। অবশেষে এই উদ্যোগে সাফল্যের দেখা মিলেছে।
শেয়ারবার্তা/ সাইফুল