সরকার চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরু থেকেই নতুন ভ্যাট আইন (মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২) বাস্তবায়ন করেছে। আইনটি বাস্তবায়নের পর রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশার কথা জানিয়েছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। তবে অর্থবছরের প্রথমার্ধের হিসাবে দেখা গেছে, ভ্যাট আদায়ে প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি। এনবিআর প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথমার্ধে ভ্যাট আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে ১০ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ৫১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৪১ হাজার ৯১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ভ্যাট আদায় বেড়েছে সাত দশমিক ছয় শতাংশ।
শুধু ভ্যাট আদায় নয়, সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে সরকার। আলোচ্য সময়ে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক—সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।
আদায়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে আমদানি শুল্ক। গত ছয় মাসে শুল্ক আদায় বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় শুল্ক আদায়ে ঘাটতি ১৩ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রয়েছে আয়কর আদায়।
রাজস্ব আদায়ে এত পিছিয়ে থাকায় নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যেও। চলতি মাসের শুরুতে এনবিআরে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি জানতে তিনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে শিগিগরই বৈঠক করবেন। শুরুতে আয়কর বিভাগ এবং পরবর্তী সময়ে শুল্ক ও ভ্যাট আদায় পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হবেন। সূত্র জানিয়েছে, এসব বৈঠকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হলেও মাঠ পর্যায়ে পুরোপুরি কঠোর অবস্থানে যায়নি এনবিআর। মূলত আইনটি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়, এ জন্য সতর্কতার সঙ্গেই আইনটি বাস্তবায়নে এগুতে চাইছে এনবিআর। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভ্যাট আদায় বাড়াতে বিশেষায়িত ইলেকট্রনিক হিসাবযন্ত্র বা ইএফডি স্থাপনের উদ্যোগ গত ছয় মাসেও বাস্তবায়ন করা যায়নি। বেশকিছু বড়ো উন্নয়ন প্রকল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ফলে উন্নয়ন কাজ বাড়লেও এর সঙ্গে ভ্যাট আদায় সাযুজ্যপূর্ণ নয়। অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে উচ্চ শুল্কের পণ্য আমদানিতেও প্রত্যাশিত গতি আসেনি। এছাড়া বড়ো অঙ্কের ভ্যাট দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও আলোচ্য সময়ে কাঙ্ক্ষিত ভ্যাট দেয়নি। সব মিলিয়ে ভ্যাট আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
অবশ্য ভ্যাটসহ রাজস্বের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। চলতি অর্থবছর প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অতীতে কখনোই এত বেশি হারে রাজস্ব আদায় হয়নি। এনবিআরের হিসাবে গত পাঁচ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে গড় প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব। ফলে চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর বাজেটে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার ফলে তা সংশোধন করে কমিয়ে আনা হয়। গত কয়েক বছর ধরেই এ প্রক্রিয়া চলছে। তারা বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট ও আদায়যোগ্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার ওপর জোর দিয়েছেন।
শেয়ারবার্তা / আনিস