ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না। তারা রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। পাশাপাশি পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনার লক্ষ্যে গঠিত কমিটির কোনো পদেও থাকতে পারবেন না।
অর্থ মন্ত্রণালয় নতুন এই বিধান রেখে ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২০’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে। খসড়ায় আরও উল্লেখ করা হয়-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর নেয়া ঋণের অর্থ পুরোপুরি বা আংশিক উদ্দেশ্যের বাইরে ব্যবহার বা স্থানান্তর করতে পারবে না। যদি কেউ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মনোনীত যে কোনো ব্যক্তিকে অপসারণ করতে পারবে। এ ছাড়া আইনে আরও নতুন বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে সংশ্লিষ্টদের কাছে মতামত চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে বলেন, এ আইনের একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে। এটি নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, ব্যাংকের ক্ষেত্রে নয়। আমার বক্তব্য হচ্ছে-নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ আইনটি যেন ব্যাংকের ওপর পুরোপুরি কার্যকর হয়।
প্রয়োজনে ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট সংশোধন করে উল্লিখিত বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তা করতে পারলে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের আইন চীনেও বিদ্যমান আছে। সূত্রমতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন-১৯৯৩ ক্ষমতাবলে দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা হচ্ছে।
এ আইনকে রোহিত করে সময়োপযোগী করতে নতুন আইন হচ্ছে। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন-২০২০’। অর্থ বিভাগ আইনটির ওপর মতামত নিয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠাবে আইন মন্ত্রণালয়ে। এরপর মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে এটি জাতীয় সংসদে আইন পাস হবে।
নতুন আইনে পরিচালকদের প্রসঙ্গে বলা হয়, কোনো পরিচালক একাদিক্রমে তিন মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। তবে টানা তিন মেয়াদে পরিচালক পদে থাকলে তৃতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন বছর পর ওই কোম্পানির পরিচালক পদে পূর্ণ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।
সেখানে আরও বলা হয়, ‘যাহা কিছু থাকুক না কেন এ আইন কার্যকরের অব্যাহতি পূর্বে কোনো ব্যক্তি একাদিক্রমে তিন মেয়াদে বা নয় বছরের অধিক পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে এ আইন কার্যকর হওয়ার তিন বছর অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিচালক পদ শূন্য হবে।’
ফাইন্যান্স কোম্পানির ঋণখেলাপি পরিচালকদের উদ্দেশে নতুন আইনে বলা হয়, ঋণ প্রদানকারী ফাইন্যান্স কোম্পানি বা ব্যাংকের পরিচালকের পদত্যাগ পর্ষদের সম্মতি ছাড়া কোনোভাবে কার্যকর হবে না। এ ছাড়া আইনের উপধারা(১),(২) ও (৩) অনুযায়ী কোন ফাইন্যান্স কোম্পানির পরিচালক নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিচালক হিসেবে অধিষ্ঠিত না থাকলেও তার বকেয়া ঋণ নিয়মিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত থাকবেন।
জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর বেশিরভাগ ধারা-উপধারা ও বিধান নতুন আইনে বহাল রাখা হয়েছে। তবে নতুন আইনে নতুন বিধানে আরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ যে কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানির পরিচালকের সংখ্যা পনেরোজনের বেশি হবে না। তবে শর্ত হচ্ছে-এ ধারার বিধান তালিকাভুক্ত ফাইন্যান্স কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কর্তৃত্বকে ক্ষুণ্ন করবে না।
সেখানে আরও বলা হয়-আইনে বা বর্তমান বলবৎ অন্য কোনো আইনে বা কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানির স্মারক-সংঘ বা সংঘ বিধিতে যাই থাকুন না কেন নতুন আইনের বিধানই কার্যকর হবে।
ঋণ দেয়ার বিধানে বলা হয়, কোনো একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে ঋণ দেয়ার পরিমাণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন ও রিজার্ভের ত্রিশ শতাংশে বেশি বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতিসহকারে একশ’ শতাংশের বেশি হবে না। নতুন আইনে গ্রুপ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয় ঋণগ্রহীতা এবং তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যাদের একজনের আর্থিক সচ্ছলতা অন্যজনের আর্থিক সচ্ছলতাকে প্রবাহিত করে বা তাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের কারণে একজনের দায় বা সুবিধা অন্যজনের ওপর বর্তায় এরূপকে বোঝানো হয়েছে।
নতুন আইনে বিনিয়োগের সীমা প্রসঙ্গে বলা হয়, প্রত্যেক ফাইন্যান্স কোম্পানি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমা সমষ্টিগতভাবে প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন বা রিজার্ভের ২৫ শতাংশের বেশি হবে না। তবে শর্ত হচ্ছে-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে পরিশোধিত মূলধন বা রিজার্ভের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। এ ছাড়া কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবসিডিয়ারি ভিন্ন কোনো কোম্পানিতে তার পরিশোধিত মূলধন বা রিজার্ভের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার অর্জন বা ধারণ করবে না।
তবে শর্ত হচ্ছে- এই আইন কার্যকরের পাঁচ বছরের মধ্যে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে আরও তিন বছরের মধ্যে প্রত্যেক কোম্পানি অন্য কোম্পানির অর্জিত শেয়ার বা ধারণকৃত শেয়ার নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নামিয়ে আনবে। এ ছাড়া নতুন আইনে বলা আছে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থ বা আমানতকারীদের স্বার্থ পরিপন্থী পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হলে ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল, স্থগিত করা হবে।
বিশেষ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত ও পুনর্গঠন প্রসঙ্গে আইনে বলা হয়-কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বতঃপ্রেণোদিত হয়ে অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চাইলে বা নিজের ব্যবসার কিয়দংশ অন্য কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে বা বিদ্যমান দায়-সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে পুনর্গঠিত হতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই কোম্পানি অবসায়নের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারবে।
শেয়ারবার্তা / হামিদ