বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে এর পরিমাণ ছয় হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকেরই পাওনা ছিল চার হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকের মূলধনের ৯০ শতাংশ ছিল। প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া বেশির ভাগ ঋণেরই বর্তমানে সরকারি কোনো গ্যারান্টি নেই। এ ক্ষেত্রে ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত ব্যাংকগুলো। তবে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত সোনালী ব্যাংক। কারণ ব্যাংক কম্পানি আইন ভঙ্গ করেই চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ও সরকারি গ্যারান্টি ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়ায় সোনালী ব্যাংকের ব্যাখ্যা তলবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সপ্তাহেই ব্যাখ্যা তলব করা হবে বলে জানা গেছে।
গত ১৪ নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের সমঝোতা স্মারক নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে বিপুল অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়। সভায় জানানো হয়, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ছয় হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালে নতুন অনুমোদিত ৫১৩ কোটি টাকাসহ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে সোনালী ব্যাংকেরই পাওনা চার হাজার ২৪৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মূলধনের ৯০ শতাংশ।
জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে এই ঋণের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টির মেয়াদও এরই মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টি গ্রহণের শর্ত থাকলেও মন্ত্রণালয় কর্তৃক কোনো গ্যারান্টি প্রদান করা হয়নি। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গ্যারান্টি প্রদান করা না হলে সোনালী ব্যাংকে আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। সভায় বিএইচএফসির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের বিষয়ে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের এমডিরা গভর্নরের সহযোগিতা কামনা করেন।
ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো একক গ্রহীতার অনুকূলে একটি ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারবে না। কিন্তু জুন পর্যন্ত হিসাবে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে সোনালী ব্যাংকের মূলধনের ৯০ শতাংশের বেশি ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়। আর নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে তা ১০৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। একক ঋণগ্রহীতার অনুকূলে এত পরিমাণ ঋণ দিয়ে ঝুঁকিতে আছে ব্যাংকটি।
সোনালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান এ বিষয়ে বলেন, চিনিশিল্প করপোরেশনকে ঋণ হিসেবে এই অর্থ দেওয়া হয়েছে। এটা বড় অ্যামাউন্ট এটা ঠিক। তবে যেহেতু আমরা সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছি, তাই এই টাকা আমরা ফিরে পাব বলে আশা করছি। সরকারের গ্যারান্টি না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু ঋণের সরকারি গ্যারান্টি ছিল, সেটার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। অন্যগুলোতে করপোরেশনের গ্যারান্টি আছে। তবে যেগুলোর সরকারি গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলো রিনিউ করার আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি, সরকারের গ্যারান্টিও পাব।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ঋণ রয়েছে চিনিশিল্প করপোরেশনের কাছে ১১০০ কোটি টাকার বেশি। এর পরও সম্প্রতি আরো ৩০০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আবদুছ ছালাম আজাদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা ৩০০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করেছি। তবে এখানে শর্ত দেওয়া হয়েছে, সরকারের গ্যারান্টি পেলেই এই অর্থ ছাড় করা হবে। এ ছাড়া করপোরেশনের আগের ঋণগুলো নবায়ন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।’
চিনিশিল্প করপোরেশনের কাছে সুদসহ ৬২৫ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের। কিছুদিন আগে ওই টাকা ব্যাংকটি ফেরত চাইতে গেলে সংকটের কথা বলে উল্টো আরো ৫০০ কোটি টাকার ঋণ চেয়ে বসে প্রতিষ্ঠানটি। যোগাযোগ করা হলে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, বিভিন্ন সমস্যার কারণে টাকা ফেরত দিতে পারছে না চিনিশিল্প করপোরেশন। আবার এসব ঋণের সরকারি গ্যারান্টিও আনতে পারছে না করপোরেশন। গ্যারান্টি না পেলে ব্যাংকগুলো ওই ঋণখেলাপি করে ফেলবে। তখন নতুন কোনো ঋণ পাবে না প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যদিকে চিনিশিল্প করপোরেশনের কাছে রূপালী ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৫৮০ কোটি টাকা।
বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে চিনিশিল্প করপোরেশন। নিজেদের সংকটের কথা তুলে ধরে কয়েক দফা শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, করপোরেশনে দীর্ঘদিন চরম আর্থিক সংকট বিরাজ করায় চিনিশিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে।
চিনিশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান অজিত কুমার পালিএ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ৬০ টাকা। বিপরীতে বাজারে চিনি বিক্রি করি ৫০ টাকায়। ফলে প্রতি কেজি চিনিতে আমাদের লোকসান তথা ট্রেডগ্যাপ ১০ টাকা। চিনির উৎপাদন মূল্য ও বিক্রয় মূল্যের পার্থক্য ভর্তুকি হিসেবে সরকারের দেওয়ার কথা। ২০১২ সাল পর্যন্ত ট্রেডগ্যাপ হিসেবে সরকারের কাছে আমাদের পাওনা ছিল ১৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৪৩০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। বাকি রয়েছে আরো ১২৭০ কোটি টাকা। আর ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আরো ১২০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সব মিলে ট্রেডগ্যাপ পাওনা আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই অর্থ পেতে প্রচুর চেষ্টা করেছি, হাত-পা ধরেছি, কিন্তু পাওনা টাকা পাচ্ছি না।
শেয়ারবার্তা / মিলন