তোপের মুখে পড়েছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর কর্ত্যাব্যক্তিরা। গতকাল (বুধবার) পুঁজিবাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য আয়োজিত এক বৈঠকে স্টেকহোল্ডারদের তোপের মুখে পড়েন তারা। বৈঠকে দুর্বল মৌলভিত্তির আইপিও অনুমোদন, আইপিও পরবর্তী লেনদেনে শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য, সার্ভিল্যান্সের গাফিলতি, কারসাজির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়াসহ নানা অভিযোগের তিরে নাস্তানাবুদ করে ফেলেন বিএসইসির কর্মকর্তাদের। বৈঠক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) নির্বাহী কমিটি, শীর্ষ ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকার এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বিএসইসির কমিশনার ড. স্বপন কুমার বালা এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান এবং পরিচালক শেখ মাহবুবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকে পুঁজিবাজারে প্রায় টানা পতন চলছে। নতুন বছরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে এমন আশা করা হলেও বাস্তবে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। চলতি জানুয়ারি মাসের পতনের তীব্রতা আগের পতনগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ইডএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৩৮৪ পয়েন্ট বা প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে। টানা পতনের প্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীরা ফের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। এমন অবস্থায় পুঁজিবাজার সংক্রান্ত অর্থমন্ত্রণালয় গঠিত তদারক কমিটি আগামী ২০ জানুয়ারি, সোমবার বৈঠক ডেকেছে। তার আগে বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও অবস্থার উন্নয়নে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ জানার লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএসইসি।
জানা গেছে, বৈঠকে বিএসইসির পক্ষ থেকে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির কারণ সম্পর্কে স্টেকহোল্ডারদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ জানতে চাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে স্টেকহোল্ডাররা বাজারের এই পতন ধারার জন্য অন্যান্য কারণের পাশাপাশি বিএসইসি সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো ইস্যুগুলো তুলে ধরেন।
বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি যেসব আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে, তার বেশির ভাগই অত্যন্ত দুর্বল মৌলভিত্তির। কিন্তু তা সত্ত্বেও তালিকাভুক্তির পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত এসব শেয়ার ৬ গুণ/৭ গুণ দামে লেনদেন হয়েছে। আর এটি হয়েছে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কারসাজির মাধ্যমে। তারা শেয়ারের দাম বাড়িয়ে প্লেসমেন্টে পাওয়া তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছেন। তাদের শেয়ার বিক্রি হওয়ার পর থেকে কোম্পানির আয় এবং শেয়ারের দাম কেবলই কমেছে। কিন্তু এই কারসাজির বিষয়ে বিএসইসি কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
বৈঠকে স্টেকহোল্ডাররা অভিযোগ করেন, শুধু নতুন আইপিওর শেয়ার নয়, পুরনো জাঙ্ক শেয়ার নিয়েও বাজারে নিয়মিত কারসাজি হচ্ছে। কারখানা বন্ধ, উৎপাদন নেই, বিক্রি নেই অথচ ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার বাজারে ৬শ/৭শ টাকায় কেনা বেচা হয়। কোনো কোনোটি এরচেয়েও বেশী দামে কেনাবেচা হয়েছে। কারসাজি ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কিন্তু কারসাজি বন্ধ ও দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে বিএসইসি কোনো উদ্যেগ নেয়নি। অথচ বিএসইসিতে স্টেট অব দ্যা আর্ট সার্ভিলেন্স সফটওয়্যার রয়েছে। তারা প্রশ্ন করেন, কারসাজিই যদি চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে এত দামি সফটওয়্যার রেখে লাভ কী?
তারা আরও অভিযোগ করেন, দুয়েকটি ক্ষেত্রে বিএসইসি ব্যবস্থা নিলেও সেটি হয়ে থাকে ঘটনা ঘটে যাওয়ার ৫/৭ বছর পর। এতে বাজারে কোনো প্রভাব পড়ে না।
বৈঠকে ডিবিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর হিসাবকারসাজি চরমে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি কোম্পানি ২/৩ টি ধরনের হিসাব পরিচালনা করে। কিন্তু এগুলো বন্ধের উদ্যোগ নেই কোনো তরফে।
ডিবিএর অন্য একজন কর্মকর্তা আইসিবির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলেন। তিনি বলেন, এক সময় আইসিবি বাজার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতো। এখন এটি শেয়ার ডাম্পিং এর ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অসাধু উদ্যোক্তা ও কারসাজিকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে আইসিবি ব্লকে উচ্চ মূল্যে পঁচা শেয়ার কিনে নেয়, কেয়া কসমেটিকস, ইফাদ অটো, ড্রাগন সোয়েটারসহ এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
ডিবিএর অন্য একজন কর্মকর্তা ব্রোকার-মার্চেন্ট ব্যাংকারদের মতো তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে নিয়েও এমন বৈঠক করার আহ্বান জানান।
ব্যাংকভিত্তিক একটি ব্রোকারহাউজের কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানি আইনের কিছু ধারার কারণে বাজারে শেয়ারের চাহিদা বাড়ছে না। পতনমুখী বাজারে অনেকেই তুলনামূলক কম দামে শেয়ার কিনে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের সদস্য হতে ইচ্ছুক। কিন্তু কোম্পানির অন্য পরিচালকরা কো-অপ্ট করতে আগ্রহী নয় বলে তারা পর্ষদে যেতে পারেন না। পর্ষদে যাওয়ার সহজ সুযোগ থাকলে দু’ভাবে বাজার উপকৃত হতো। প্রথমত এর ফলে বাজারে শেয়ারের চাহিদা বাড়ত। অন্যদিকে তাদের অন্তর্ভুক্তির ফলে পর্ষদে আরও স্বচ্ছতা এবং গতি বাড়ত।
বৈঠকে একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার বাজারের এমন পরিস্থিতিতে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওতে আসতে ইচ্ছুক কোম্পানিগুলোকে দ্রুততম সময়ে আসার সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এই সময়ে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোম্পানি বাজারে এলে বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন, বাজার বিডিং এ অন্য সময়ের তুলনায় শেয়ারের দাম উঠার সম্ভাবনা কম।
তিনি সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি) জাতীয় প্রোডাক্টে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বাড়াতে প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর জন্য বিও হিসাব খোলার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার অথবা হিসাবরক্ষণাবেক্ষণ ফি তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, কোনো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী যদি মাসে ১ হাজার টাকা করে জমা দেন, তাহলে বছরে তার বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার টাকা। এই টাকা থেকে যদি বছরে ৫শ টাকা কেটে নেওয়া হয়, তাহলে প্রায় ৪ শতাংশ কমে যায়। এমন অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা কঠিন। অথচ পাশের দেশ ভারতে এসআইপি জাতীয় প্রোডাক্টের মাধ্যমে বাজারে বিপুল পরিমাণ তহবিল আসছে।
একজন ব্রোকার অভিযোগ করেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফায় বড় ধরনের পরিবর্তন হলে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা কোনো কোম্পানিই মানছে না। বড় বিচ্যুতি বা পরিবর্তন হার নির্ধারণ করে না দেওয়ায় ওই সুযোগটি নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে কোম্পানিগুলো আর্নিংস কলও করছে না।
ব্যাংক ঋণের সুদ হারে নয়-ছয় প্রস্তাব সম্পর্কে একজন ব্রোকার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকগুলো চরম সঙ্কটে পড়বে। অনেক ব্যাংক ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিতে পারে। ব্যাপকভাবে কমে যাবে এসএমই ঋণ বিতরণের পরিমাণ। সামগ্রিক অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তা থেকে পুঁজিবাজারও বাদ যাবে না।
বিএসইসির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়, তারা এসব সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করে দেখবেন।
শেয়ারবার্তা / আনিস