পুঁজিবাজারে চলছে টানা দরপতনের মাতম। চলতি বছরে মোট লেনদেন হয়েছে ১০ কার্যদিবস। এর মধ্যে ছয় কার্যদিবসই ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে এক শতাংশের বেশি। এর জেরে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ফান্ডের শেয়ার এবং ইউনিটের বাজার মূলধন। ১০ দিনে বাজার মূলধন কমেছে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা ১৩ জানুয়ারি বড় পতন দেখার পর ভেবেছিলেন গতকাল মঙ্গলবার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু এদিনও বড় পতন দেখতে হয়েছে তাদের। সকাল থেকেই পতন শুরু হয়। দিনের এক পর্যায়ে সূচক ১১২ পয়েন্ট কমে যায়। পরবর্তীকালে পতনের মাত্রা কিছুটা কমে দিন শেষে সূচক স্থির হয় চার হাজার ৩৬ পয়েন্ট। সূচক কমে ৮৭ পয়েন্ট।
এদিকে পতনের জেরে গতকাল বাজার মূলধন কমে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এ নিয়ে চলতি বছর ২৬ হাজার ১৫৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা মূলধন হারিয়েছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি লেনদেনের শুরুতে ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। অব্যাহত দরপতনের কারণে গতকাল তা তিন লাখ ১৩ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় নেমে আসে।
জানুয়ারিতে লেনদেন হওয়া ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সাত দিনই সূচক ছিল নিম্নমুখী। আর এ সময়ে ডিএসই’র প্রধান সূচক কমেছে ৪১৬ পয়েন্ট। টানা দরপতনের কারণে ডিএসই’র সূচক চার বছর আট মাস আগের অবস্থানে চলে গেছে। এর আগে ২০১৫ সালের ৫ মে এর নিচে ছিল সূচকের অবস্থান। ওইদিন ডিএসইর সূচক ছিল চার হাজার ১৪ পয়েন্ট।
অন্যদিকে আগের দিনের মতো গতকাল দিনজুড়েই প্রায় সব কোম্পানিতে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা বেশি ছিল। ফলে কম দরে শেয়ার বিক্রি করতে দেখা গেছে ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের।
এদিকে পতনের জেরে গতকাল মতিঝিলে ডিএসই’র সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময় তারা বিএসইসিসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের রদবদলের আহ্বান জানান।
বিনিয়োগকারীরা জানান, পতন যত বড় হচ্ছে, তাদের উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন তারা। পতনের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। পুঁজিবাজার নিয়ে তারা খুবই শঙ্কিত। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে অবস্থা আরও করুণ হবে বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন। তাদের অভিমত, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ইচ্ছা করে কৃত্রিমভাবে এই পতন ঘটাচ্ছে। মূলত কম দরে শেয়ার কেনার জন্য তারা বাজার থেকে দূরে রয়েছে।
জানতে চাইলে বিনিয়োগকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানের পতন ২০১০ সালের পতনকেও হার মানিয়েছে। এ ধরনের টানা পতন সে সময়ও দেখা যায়নি। তিনি বলেন, দর কমবে না বলে যে শেয়ারগুলো ১৫ টাকার কমে কিনেছিলাম, সেগুলোও ১০ টাকার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এসব শেয়ারের মৌলভিত্তিও ভালো। তারপরও এগুলোর দরে যেভাবে পতন হচ্ছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাজার নিয়ে কেউ কারসাজি করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
বাজারসংশ্লিষ্টরা পুঁজিবাজারের এমন পরিস্থিতির জন্য দুর্বল কোম্পানির তালিকাভুক্তিকে দায়ী করছেন। পাশাপাশি বিএসইসি’র পুনর্গঠনও দাবি করেন তারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘এখন যে পতন চলছে, এটা এক অর্থে স্বাভাবিক। গত দুবছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারের এমন গতিবিধি লক্ষ করা যাচ্ছে। এর কারণ, এ সময়ে কোনো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। এছাড়া বর্তমানে যিনি বিএসইসি’র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি নিয়মানুযায়ী দুবার এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু তিনি তারচেয়েও বেশি সময় ধরে একই দায়িত্বে রয়েছেন। যে কারণে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠছে। আমার মনে হয়, বিএসইসি পুনর্গঠন দরকার। এখানে যে কাউকে দায়িত্ব দিলে হবে না। দিতে হবে যোগ্য লোককে, যিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। এছাড়া ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে যারা পুঁজিবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার হয়নি। যে কারণে অন্যরা বাজার নিয়ে কারসাজি করতে দুবার ভাবে না।’
একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুঁজিবাজার ঠিক করতে হলে সবার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুনর্গঠন জরুরী। কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা শুন্যের কোটায় নেমে গেছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের উচিত সঠিক দায়িত্ব পালন করা। পৃথিবীর সব দেশে বাজারের যে কোনো বৈরী পরিবেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাপোর্ট দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টো। বাজারে তাদের আচরণ ডে-ট্রেডারদের মতো। যে কারণে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
শেয়ারবার্তা / হামিদ