বন্ড মার্কেটে বীমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য বীমা কোম্পানির বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগের বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী মাস থেকে এ কার্যক্রম শুরু করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বর্তমানে বন্ড মার্কেটে বীমা কোম্পানিগুলোর ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। এটি মোট বন্ড মার্কেটের মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। বীমা কোম্পানিগুলোর আরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। সেকেন্ডারি বাজারে বন্ড লেনদেন শুরু হলে সেটি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে ইন্স্যুরেন্স ডেভেলমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনকে (বিআইএ) আলাদা চিঠি দিয়ে বীমা কোম্পানিগুলোকে বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগের আহ্বান জানাবে। এর পাশাপাশি জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আমন্ত্রণ জানাবে। ওই বৈঠকে বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগের উপকারিতা ও সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত। নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদে বন্ড মার্কেটে যে কোনো সময় বিনিয়োগ করা যায়। যে কোনো সময় টাকার প্রয়োজনে বিক্রি করে বিনিয়োগ মুনাফাসহ তুলে নেয়া যায়। অন্যদিকে ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য শরিয়াহ্সম্মত ইসলামিক বন্ডও রয়েছে।
এদিকে বর্তমানে বীমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে। এরমধ্যে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর সর্বমোট ১৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এটি সরকারি বন্ড মার্কেটের প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। আর সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ মাত্র ১০৯ কোটি টাকা। এটি বন্ড মার্কেটের মাত্র ০.০৫ শতাংশ।
এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে আহ্বান জানাবে। তারা চাইলে আরও বেশি বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। সেকেন্ডারি মার্কেট চালু হলে এ সুযোগ বাড়বে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) কোম্পানি সচিব সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে অলস টাকার পরিমাণ কম থাকে। কারণ সাধারণ বীমা পলিসিগুলো এক বছরের জন্য হয়ে থাকে। তাই প্রতি বছরই গ্রাহকের টাকা দেয়া হয়। কিন্তু জীবন বীমা কোম্পানির কাছে অনেক অলস টাকা থাকে। সেজন্য তাদের বিনিয়োগ বেশি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, খুব শিগগিরই সেকেন্ডারি বাজারে বন্ড লেনদেন শুরু হবে। সেক্ষেত্রে কোনো বীমা কোম্পানি চাইলে স্বল্প মেয়াদেও বিনিয়োগ করতে পারবে। এক সপ্তাহের জন্যও বিনিয়োগ করতে পারবে। নির্ধারিত মুনাফাসহ পরের সপ্তাহেই বিনিয়োগ তুলে নিতে পারবে। এমনকি এক দিনের জন্যও বিনিয়োগ করতে পারবে। এতে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ করতে কোনো সমস্যা হবে না। ব্যাংকের এফডিআর থেকেও অনেক বেশি সুবিধা পাবে বন্ড মার্কেটে। বিনিয়োগের মুনাফাও আকর্ষণীয়।
বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বীমা কোম্পানিগুলো। বীমা কোম্পানির অলস টাকা বন্ডে বিনিয়োগ করা নিয়ে আগেও বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, কাঙ্খিত মুনাফা না পাওয়ায় বীমা কোম্পানিগুলো বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত, ব্যাংকের মতো বন্ডেও ভালো মুনাফা নিশ্চিত করা।
এখন পর্যন্ত বন্ড মার্কেটের সুবিধা কেবল সরকারি খাতেই গ্রহণ করা হচ্ছে। ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে বীমা কোম্পানিগুলো দেশীয় বন্ডে তেমন বিনিয়োগ করছে না। এ বিষয়ে ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. খুরশীদ আলম বলেন, বন্ড মার্কেট উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে বীমা কোম্পানির বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টিও রয়েছে। ইতিমধ্যে বীমা কোম্পানি, শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বিষয়গুলো নিয়ে প্রস্তাবনা রয়েছে।
এদিকে সাধারণ বীমা কোম্পানির সম্পদ বিনিয়োগের প্রবিধান চূড়ান্ত করা হয়েছে। লাভজনক খাতে বিনিয়োগ ও আমানত সুরক্ষিত রাখতে বিনিয়োগের ৯টি খাত নির্ধারণ করেছে আইডিআরএ। সম্প্রতি ওই বিধিমালার গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।
নতুন বিধিমালায় সাধারণ বীমা কোম্পানির বিনিয়োগের জন্য ৯টি খাত নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকার নিষ্কণ্টক স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়, আবাসিক-দাফতরিক কাজে ব্যবহারের জন্য বন্ধক বা লিজ, সহযোগী প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে মোট সম্পদের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে মোট সম্পদের সাড়ে সাত শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে। সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো মোট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাধারণ বা প্রেফারেন্স উভয় প্রকারের শেয়ার কিনতে পারবে। তবে কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করা যাবে না। একইভাবে একটি কোম্পানির শেয়ার কিনতে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো মোট সম্পদের পাঁচ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে না। ঝুঁকি এড়াতে পুঁজিবাজারের ‘জেড’ ক্যাটেগরির শেয়ারে বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
স্থাবর সম্পত্তি ও লিজ-বন্ধকি সম্পত্তিতে বিনিয়োগের বিষয়টিও প্রবিধানে গুরুত্ব পেয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় দায়হীন-নিষ্কণ্টক সম্পত্তি কিনতে সম্পদের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যাবে। এছাড়া আবাসিক বা দাফতরিক কাজে ব্যবহারের জন্য সম্পত্তি বন্ধক বা লিজ নিতে সম্পদের সাত শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যাবে। তবে এ খাতে মোট সম্পদের ২০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা যাবে না। নতুন প্রবিধান কার্যকরের পর সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো মোট সম্পদের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত তফসিলি ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখতে পারবে। তবে একটি তফসিলি ব্যাংকে মোট সম্পদের ১৫ শতাংশের বেশি রাখা যাবে না। সেইসঙ্গে ‘এ’ রেটিংয়ের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট সম্পদের ১০ শতাংশ গচ্ছিত রাখা যাবে। তবে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দু’ শতাংশের বেশি বিনিয়োগের সুযোগ নেই।
এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতি নিয়ে শর্তসাপেক্ষে সহযোগী বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতেও সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে পারবে। এক্ষেত্রে সম্পদের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। একইভাবে আরও পাঁচ শতাংশ অনুমোদিত খাতে বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে। এর বাইরে সরকারি অনুমোদন নিয়ে সিটি করপোরেশনের ইস্যু করা ডিবেঞ্চার বা অন্য সিকিউরিটিজে পাঁচ শতাংশ ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদিত ডিবেঞ্চারে ১৫ শতাংশ সম্পদ বিনিয়োগ করতে পারবে কোম্পানিগুলো।
সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের মোট সম্পদের অন্তত ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে হবে। এছাড়া ব্যাংকবহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশের বেশি সম্পদ রাখা যাবে না। ব্যাংকে গচ্ছিত স্থায়ী আমানতের বিপরীতে বীমা কোম্পানি কোনো ঋণও নিতে পারবে না। প্রস্তাবিত সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা, ২০১৭-তে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড ও অন্যান্য সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের এসব সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।
শেয়ারবার্তা/ সাইফুল