রাষ্ট্রা্য়াত্ব বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর বিতর্কিত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী সানাউল হককে উচ্চ বেতনে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পর্ষদের একটি অংশ। যা তার সাবেক কর্মস্থল আইসিবি থেকে প্রায় সাড়ে ৪ গুণ বেশি। একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে এমন উচ্চ বেতনে ডিএসইর পর্ষদের নিয়োগ দেওয়াকে মানতে পারছেন না ব্রোকাররা।
নানা কারণে কাজী সানাউল হক পুঁজিবাজারে বিতর্কিত। তাকে ডিএসইর এমডি পদে নিয়োগের প্রস্তাবও করেছে ডিএসইর পর্ষদের একজন ‘বিতর্কিত’ প্রভাবশালী পরিচালকের নেতৃত্বে একটি অংশ। গত বৃহস্পতিবার (০৯ জানুয়ারি) ডিএসইর পর্ষদে উপস্থিত পরিচালকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬ জনের সম্মতিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যার নিয়োগে ৩ জন বা ৭৫ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার পরিচালকসহ ৪ জন সম্মতি দেননি। তবে পর্ষদ নিয়োগ দিলেও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন লাগবে। অর্থাৎ কাজী সানাউল হকের চূড়ান্ত নিয়োগের বিষয়টি এখন বিএসইসির কোর্টে।
ডিএসই’র এক কর্মকর্তা বলেন, উচ্চ পদে সরকারি প্রতিষ্ঠানের থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন বেশি হওয়া স্বাভাবিক। যেমনটি আইসিবির এমডির তুলনায় ডিএসইর এমডির ক্ষেত্রেও হয়। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেই বেশি বেতন পেতে প্রয়োজন হয় দক্ষতার। সেখানে বিতর্কিত কারো বেতন বেশিতো দূরের কথা, চাকরী পাওয়াই অসম্ভব। যদি না বিশেষ কোন কারন থাকে।
আইসিবির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ি, বর্তমানে বেকার থাকা কাজী সানাউল হক আইসিবিতে ওই অর্থবছরে মোট ২৬ লাখ ২৪ হাজার ৫০৮ টাকা বেতন পান। যা মাসিক হিসাবে ছিল ২ লাখ ১৮ হাজার ৭০৯ টাকা। তাকে ডিএসইর পর্ষদের একটি অংশ মাসিক প্রায় ১২ লাখ টাকা বেতনে নিয়োগ দিয়েছে। এতে তার মাসিক বেতন বৃদ্ধি পাবে ৯ লাখ ৮১ হাজার ২৯১ টাকা বা ৪৪৯ শতাংশ। যা বিএসইসির অনুমোদনের মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে।
ডিএসই কর্তৃপক্ষ কাজী সানাউল হককে মাসিক গ্রোস ৮ লাখ টাকা বেতনের পাশাপাশি দুই ঈদ বোনাস, গাড়ি, গাড়ির জ্বালানি, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষন খরচ, ড্রাইভারের বেতন, লাইফ ইন্স্যুরেন্স, চিকিৎসা, স্ত্রীর চিকিৎসা, ছেলে-মেয়েদের চিকিৎসা ও মোবাইল বিলবাবদ প্রায় ৪ লাখ টাকা দেবে। যাতে সানাউলের জন্য ডিএসইর মাসিক ব্যয় হবে প্রায় ১২ লাখ টাকা।
ডিএসইর একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রথমত ‘বিতর্কিত’ কাজী সানাউল হককে এমডি হিসেবে দেখতেই চান না। আর সাড়ে ৪ গুণ বেশি বেতনে নিয়োগতো দূরের বিষয়। এই বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ায় পর্ষদের দক্ষতা নিয়ে অনেক সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন। একইসঙ্গে ডিএসইর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে নিয়োগ দেওয়ার কারন তাদের কাছে অজানা।
তারা জানান, ডিএসই এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং শেয়ারহোল্ডারদেরকে লভ্যাংশ দিতে হয়। যাতে ব্যবসায় মুনাফা অর্জন ও লভ্যাংশ দেওয়ার জন্য একজন দক্ষ এমডি দরকার। কিন্তু যিনি আইসিবিতে এমডি থাকাকালীন প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় ধস নামে, সে কিভাবে ডিএসইর মুনাফা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে এমন প্রশ্ন তাদের মনে।
কাজী সানাউল হকের বিষয়ে আগে থেকেই বিতর্ক রয়েছে। তিনি বিডিবিএলের বিনিয়োগ বিভাগের জিএম পদে থাকাকালীন দূর্বল সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারীর শেয়ার কেলেঙ্কারীর ঘটনায় জড়ায় প্রতিষ্ঠানটি। এরফলে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বিডিবিএলকে শাস্তি দিয়ে চিঠি দেয় বিএসইসি। তার সময়কালীন আইসিবির মুনাফায়ও বড় ধস নামে।
কাজী সানাউল হক আইসিবির এমডি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত। তার দায়িত্ব গ্রহণের আগের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) আইসিবির মুনাফা হয়েছিল ৪৬১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৭.২৯ টাকা। যা তার নেতৃত্বাধীন প্রথম অর্থবছরে (২০১৭-১৮) কমে আসে ৪১৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৬.২৭ টাকায়। আর ২য় অর্থবছরে (২০১৮-১৯) রীতিমতো ধস নামে। ওই অর্থবছরে আইসিবির মুনাফা হয় মাত্র ৬০ কোটি ১৩ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৮৬ টাকা।
আইসিবির সাবেক এমডি কাজী সানাউল হককে আইসিবির অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তলব করার ঘটনাও আছে। তার দায়িত্বরত অবস্থায় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। শেয়ার ব্যবসায় জড়িত যেসব লোক ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন তাদের ঋণ দেয়া, যাকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার কথা তাকে কয়েক কোটি টাকা করে ঋণ দেয়ার ঘটনা ঘটে। এসবের মাধ্যমে সরকারের ১৩৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।
শেয়ারবার্তা / আনিস