বীমা আইন ২০১০ (২০১০ সনের ১৩ নং আইন এর ৫৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা অর্জন বা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বীমা এজেন্ট বা এজেন্ট নিয়োগকারী বা ব্রোকার ছাড়া অন্য কাউকে কমিশন বা অন্য কোন নামে কোনো পারিশ্রমিক বা পরিতোষিক পরিশোধ করবে না বা এজন্য কোন চুক্তি করবে না (প্রথম আলো ২৬/১০/২০১৯)।
শুধুমাত্র বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের লাইসেন্সধারি এজেন্টকে ৫% অগ্রীম কর কর্তন করে ১৪.২৫% কমিশন পরিশোধ নিশ্চিত করার নির্দেশ প্রদান করা হলো। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (৮/৯/২০১৯)।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন এর বিজ্ঞপ্তি’র মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়ের সাথে (১) ১লা আগষ্ট-২০১৯ থেকে ১৫% এর বেশি এজেন্ট কমিশন প্রদান করা যাবে না (২) কোনো কোম্পানি ১৫% বেশি এজেন্ট কমিশন প্রদান করলে বীমা আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন (প্রথম আলো “১১/০৭/২০১৯)”। কিন্তু বীমা গ্রহীতা যে এর দাবিদার না তার কোন স্পষ্ট উল্লেখ নেই।
বাংলাদেশ নন-লাইফ বেসরকারি বীমা কোম্পানি বীমা গ্রহীতাকে ৩১ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত অধিক হারে কমিশন প্রদান করে আসছিল (যা সকলের জানা)। বীমা গ্রহীতা সেটাকেই তাদের ন্যায্য পাওনা বলে ধরে নিয়েছিলেন। বর্তমান অগ্রিম কর ৫% কর্তনসহ ১৪.২৫% কমিশন প্রদানের যে কথা বলা হচ্ছে বীমা গ্রহীতা এটাও তাদের ন্যায্য পাওনা মনে করে বীমা কোম্পানির নিকট থেকে আদায় করে নিচ্ছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বীমা গ্রহীতাদের এ ভ্রান্ত ধারনা দূর করার জন্য পর্যাপ্ত প্রচারণার প্রয়োজন বলে সুধিজন মনে করেন। প্রশ্ন জাগে এজেন্ট কমিশন কার? বীমা এজেন্টের নাকি বীমা গ্রহীতার!
অর্থনীতিতে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য থাকার কথা বলা হয়েছে। এর কোনো একটি’র মধ্যে ব্যত্যয় ঘটলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বীমা কোম্পানির আধিক্য এবং বীমা পণ্যের স্বল্পতা বীমা ক্ষেত্রের সমস্যার প্রধান কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। বীমা পণ্যের স্বল্পতার কারণে ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য যে-যেভাবে পারছে ব্যবসা সংগ্রহ করছে। যাকে বলা হয় অনৈতিক প্রতিযোগিতা। বীমা গ্রহীতা এই অনৈতিক প্রতিযোগিতার সুযোগ নিচ্ছে। সরকার বারবার আইন মেনে ব্যবসা করার জন্য বলছে কিন্তু বীমা কোম্পানিগুলো (প্রকাশ্য-গোপন ) তা অমান্য করছে।
টেরিফ/রেটিং কমিটি’র স্থিরকৃত প্রিমিয়াম অনুযায়ী বীমার প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়। এটাই বীমা আইন, তথাপি যখন কোনো প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি বীমা কোম্পানির নিকট থেকে দরপত্র আহবান করে তখন বিভিন্ন কোম্পানির দরপত্রের মধ্যে গড়মিল পরিলক্ষিত হয়। গ্রহীতা সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকেই বীমা ক্রয় করে থাকেন। কিন্তু এমনটি হবার কথা নয়। কারণ টেরিফ রেইট মানলে সব বীমা কোম্পানির দরপত্রে সম অঙ্ক থাকার কথা ।
বাংলাদেশে প্রধানত বীমা গ্রহীতা (১) ব্যাংক, ঋণদানকারি প্রতিষ্ঠান/ভিনদেশি বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা/শিল্প প্রতিষ্ঠান/বড় ও মাঝারি ব্যবসা(২) ভিনদেশি দূতাবাস, বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি পরিবহন ইত্যাদি এর বাইরে দেশের মধ্যে বীমা যোগ্য সুবিশাল বীমা ক্ষেত্র বিদ্যমান। সচেতনার অভাব এবং প্রচার প্রচারণায় অবহেলার কারণে তা বীমার আওতায় আসছে না। তাছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীমা ঝুঁকি গ্রহণে বীমা কোম্পানির অনাগ্রহও এর অন্যতম কারণ ।
এ সুবিশাল অনাহরিত বীমা পণ্যকে বীমার আওতায় আনতে হলে (১) বীমার ইতিবাচক দিক উল্লে¬খ করে প্রয়োজনীয় প্রচারণা চালানো জরুরি (২) বিশেষ ঝুঁকি পূর্ণ বীমাকে গ্রহণ করতে হবে। যথা মৎস বীমা / পশু পালন ইত্যাদি (৩) অফিস আদালত। একতল বহুতল দালান কোঠা, হাট বাজার, দোকান পাট, ছোট-বড় গ্রাম বাংলার বাড়ি ঘর হাট বাজারকেও আনতে হবে বীমার অওতায়। এককথায় বীমাযোগ্য প্রতিটি পণ্যকে আইন করে বীমার আওতায় আনতে হবে। যদি তা করা যায় তা হলে বীমা পণ্যের পরিধি বৃদ্ধি পাবে এবং অনৈতিক প্রতিযোগতায় ভাটা পড়বে বলে অনেকের ধারনা।
(৫) বীমাগ্রহীতাকে বীমা ক্রয়ে আগ্রহী করতে হবে। উত্থাপিত প্রকৃত বীমা দাবি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। অনিশ্চিত বীমা দাবি প্রাপ্তি এবং জটিলতা বীমা ক্রয়ের অনিহার অন্যতম কারণ। তাই একান্ত বাধ্য না হলে কেউ বীমা করতে চায়না, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বেসরকারি পরিবহণ মালিকরা বীমা এ্যাক্টে এর দরুন পুলিশ হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য বীমা করে থাকেন এবং সাধারণত এ্যাক্টে বীমা করে ঝমেলা মুক্ত হন। তবে ব্যাংক/ঋণদান প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে যান-বাহন ক্রয় করলে প্রতিষ্ঠানের নির্দেশে কমপ্রিহেনসিভ বীমা করতে হয়।
(৬) ’সরকারী বীমা’ ‘সাধারণ বীমা কারর্পোরেশনসহ-সকল বে-সরকারি বীমা কোম্পানীর জন্য উম্মুক্ত করতে হবে।
(৭) প্রতিষ্ঠিত করতে হবে পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান।
(৮) ভারত সরকার তাদের জাতীয় ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশে নন-লাইফ বীমা কোম্পানি অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে পারে, নন-লাইফ বীমা কোম্পানির সংখ্যা অধিক এবং বীমা পণ্যের স্বল্পতার দরুন বীমা ব্যবসা বে-সরকারি বীমার কোম্পানির এবং বীমা গ্রহীতার দরকষাকষির মধ্যে সীমাবদ্ধ যে কোম্পানির যত বেশি কমিশন প্রদান করছে। বীমা গ্রহীতা সেখানে থেকেই বীমা ক্রয় করছে, তাছাড়া অধিকাংশ বীমা কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক হয় দেশের প্রধান প্রধান ব্যবসায়ী শিল্পপতি/রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী সদস্য, তাদের চাহিদা পূরণের কাজটিও করতে হয়। সম্প্রতি সরকার নন-লাইফ বীমার অব্যবস্থা দূর করার যে, উদ্যোগ নিয়েছেন যার প্রতি ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনও সহযোগিতা আশ্বাস দিয়েছেন। তারা উভয়ই সাধুবাদ পাবার দাবিদার আর এর সফলতা নির্ভর করছে, বীমা কোম্পানি বীমা ও গ্রহীতার সংযমের উপর।
১৫% এর অধিকহার বীমা গ্রহীতা কমিশন প্রদান ‘আইডিআরএ’ এবং বীমা এসোসিয়েসনের নিকট প্রকাশ্য অথবা গোপন ব্যাপার ছিল। তাই জীবননান্দীয় কায়দায় বলতে ইচ্ছে করে, এতদিন কোথায় ছিলেন? আইন বলছে, এটা এজেন্টদের পাওনা, বীমা গ্রহীতা বলছেন এটা তাদের ন্যায্য দাবি, যা তিন-যুগের অধিক কাল থেকে তারা পেয়ে আসছেন। তাই জিজ্ঞাসা কমিশন তুমি কার?
আবুল হাসনাত জায়গীরদার
উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (মার্কেটিং)
বিজিআইসি লিমিটেড
প্রধান কার্যালয়, ঢাকা।