পুঁজিবাজারের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। দরপতন এমন রুদ্রমূর্তি নিয়েছে যে, বড় বড় ব্রোকারেজ হাউসগুলো ফাঁকা, বিনিয়োগকারীদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। বিনিয়োগকারীরা ফোনেই শেয়ার কেনাবেচার অর্ডার করছেন, যার সিংহভাগই বিক্রির। পুঁজিবাজার এখন অনিশ্চিত গন্তব্যে ছুটে চলছে।
দরপতন রুখতে দায়িত্বশীলরা কোন পদক্ষেপ নেবেন বা নিলে ওই পদক্ষেপ কোনো কাজে আসবে- এমন আশাও করা ছেড়ে দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। মুনাফার আশায় যারা বিনিয়োগ করেছেন, প্রতিদিনের দরপতনে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ একটু একটু করে নিঃশেষ হতে দেখা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই।
রোববার ও সোমবার বড় দরপতনের পর আজ সোমবারও বড় দরপতন হয়েছে পুঁজিবাজারে। বাজার সংশ্নিষ্টরা জানান, আগামী এপ্রিল থেকে ব্যাংকের সব ধরনের সুদের হার সরকার বেঁধে দিতে যাচ্ছে- এমন খবরের পর ব্যাংকের শেয়ার দর হারাচ্ছে বেশি, যা পতনকে উস্কে দিচ্ছে। এটাই এখনকার দরপতনের বড় কারণ।
জানতে চাইলে ২০১০ সালের পুঁজিবাজার কারসাজির ঘটনায় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও সাবেক বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পুঁজিরবাজারের বড় সংকট সুশাসনের, যা টাকা বা অন্য কিছু দিয়ে আনা সম্ভব নয়। এ সংকটের সমাধান না হলে পুঁজিবাজার সংকটের আশু কোনো সমাধান নেই। সমাধান চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ পুরো ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ব্যাংকগুলো ফাঁকা। এরই মধ্যে সরকার সুদের হার বেঁধে দিচ্ছে। আবার সরকার প্রাত্যহিক ব্যয় মেটাতে ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বহু বছরের সর্বনিল্ফেম্ন, যথেষ্ট বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ অবস্থায় কী করে পুঁজিবাজার ভালো হবে, শেয়ার কেনার জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে- তা বোধগম্য নয়। পুঁজিবাজার অনিশ্চিত এক যাত্রায় আছে। বিনিয়োগকারীরাও বিশ্বাস করেন না, এ বাজার ঠিক হবে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।
গত ছয় মাসে দুই দফায় বাজারের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে খোদ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৈঠক করেছেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। বরং বৈঠকের পর দরপতন আরও বেড়েছে। সর্বশেষ ২ জানুয়ারি ডিএসইর পর্ষদের সঙ্গে বৈঠকের পর নতুন করে পতন শুরু হয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন পতন রুখতে নয়, নিজেদের কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে চলছে শীতল যুদ্ধ। প্রায় ছয় মাস ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) পদ শূন্য দুই পুঁজিবাজারে। ডিএসইর চিফ রেগুলেটরি অফিসারও (সিআরও) পদত্যাগ করেছেন। স্টক এক্সচেঞ্জ চলছে জোড়াতালি দিয়ে। সংশ্নিষ্ট নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও স্টক এক্সচেঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছেন না কেউ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা চাচ্ছেন তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে এ পদে বসাতে। ডিএসইর এক নেতা বলেন, সাবেক এমডি মাজেদুর রহমান অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় তাকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এমডি পদ ছয় মাস ফাঁকা। তাহলে সংকট উত্তরণে কাজ করবে কে- এমন প্রশ্ন তার।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, মঙ্গলবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ৪২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬৯টির। ৪৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫০ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ২৮১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে টানা তিন দিনের বড় পতনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ১৫০ পয়েন্টের ওপর। এতে ২০১৬ সালের ১৫ মে’র পর সূচকটি সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে।
প্রধান মূল্যসূচকের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বড় পতন হচ্ছে অপর দুই সূচকের। এর মধ্যে মঙ্গলবার ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ১০ পয়েন্ট কমে ৯৭২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এতে সূচকটি প্রায় শুরুর অবস্থানে ফিরে গেছে। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি চালু হওয়া এ সূচক শুরুতে ছিল ৯৪১ পয়েন্টে।
শেয়ারবার্তা / আনিস