শেখ হাসিনা সরকারের দোসরদের লাগামহীন লুটপাটে ব্যাংক খাতে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) আমানত না বেড়ে উল্টো কমেছে। এই সময়ে ব্যাংক খাতে আমানত কমেছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এভাবে ব্যাংক খাতে আমানত কমে যাওয়ার ঘটনা নিকট অতীতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। আগস্ট শেষে আমানতের স্থিতি ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ১০ হাজার ৯০৭ কোটি টাকার আমানত কমে গেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল ২৩ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতে আমানত প্রবাহ ঋণাত্মক ধারায় চলে যাওয়ায় আরো তীব্র হয়েছে তারল্যের সংকট। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো এখন ১৪-১৫ শতাংশের সুদ প্রস্তাব দিয়েও আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। প্রতিদিনই এসব ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় আমানত তুলে নেয়ার জন্য ভিড় করছেন আতঙ্কিত গ্রাহকরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের কারণে জুলাইয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল না। কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, ব্যাংক বন্ধের মতো সিদ্ধান্তের কারণে অর্থের লেনদেন করা যায়নি। এই কারণে ওই সময় ব্যাংক খাতে আমানত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এরপর ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছেন। অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরতও দিতে পারেনি। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি গত কয়েক বছরে ইতিবাচক ধারায় থাকলেও এর সঙ্গে ছিল তারল্যের সংকটও। এই সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলোকে প্রতি মাসেই লাখ লাখ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের শুরুতে তথা ফেব্রুয়ারিতে এই ধারের পরিমাণ ছিল ৮৪ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। যদিও বছর শেষে ডিসেম্বরে তা ৩ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, কেবল ২০২৩ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে রেকর্ড ১৯ লাখ ২২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। রেপো, বিশেষ রেপো ও অ্যাশিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে স্বল্পমেয়াদি এই ধার দেয়া হয়। দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এত পরিমাণ ধার দেয়ার নজির নেই।
আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হওয়ার পর যে ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), এক্সিম ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আগে থেকেই ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক ছিল। পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পর ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরো তীব্র হয়েছে। আমানত তুলে নিতে এই ব্যাংকগুলোয় গ্রাহকদের ভিড় বাড়তে থাকে।
এই অবস্থা উত্তরণে নগদ টাকার সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোয় তারল্যের জোগান দিতে সবল ১০টি ব্যাংককে দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১১ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে তিন মাসের জন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয়া হচ্ছে। আর ধারের বিপরীতে গ্যারান্টি দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ দুর্বল ব্যাংকগুলো ধারের টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সেটি পরিশোধ করে দেয়া হবে।