২০১০ সালে ধসের পর সূচক ও লেনদেনের ক্রমাগত পতনে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছে পুঁজিবাজার। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। এর মধ্যে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার তুলনায় বিক্রি করেছেন বেশি। এতে পাঁচ বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ সর্বনিম্ন অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাজারের মোট লেনদেনের মাত্র ৭ শতাংশ বিদেশীদের দখলে থাকলেও বাজারের ওপর এর একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে থাকলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আস্থার সংকট তৈরি হয়।
গত পাঁচ বছরের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিদেশীদের নিট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ১৭ কোটি ২ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৭ সালে বিনিয়োগ আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলারে। তবে ২০১৮ সালে এসে বিদেশীদের নিট লেনদেনের পরিমাণ ঋণাত্মক ৭ কোটি ১১ লাখ ডলারে নেমে আসে। সর্বশেষ ২০১৯ সাল শেষে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিট লেনদেন দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলারে। ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনা-বেচা মিলিয়ে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৯৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, যা ২০১৯ সাল শেষে ৯২ কোটি ৪০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশীদের মোট লেনদেনের পরিমাণ কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধনের ১৭ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দখলে। মূলত এ খাতের দুই কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড (বিএটিবিসি) এবং অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে বিদেশীদের বিনিয়োগ রয়েছে। এরপরে সবচেয়ে বেশি ওষুধ খাতের কোম্পানিগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। এ খাতের কোম্পানিগুলোর মোট বাজার মূলধনের ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশই হচ্ছে বিদেশীদের কাছে। ব্যাংকিং খাতের মোট বাজার মূলধনের প্রায় ৯ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার মূলধনের সাড়ে ৬ শতাংশ রয়েছে বিদেশীদের কাছে। টেলিযোগাযোগ খাতের বাজার মূলধনের ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ বিদেশীদের দখলে। এছাড়া বস্ত্র, প্রকৌশল, বিবিধ, তথ্যপ্রযুক্তি, ভ্রমণ ও অবকাশ, সেবা ও আবাসন, ট্যানারি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, সাধারণ বীমা, সিমেন্ট, জীবন বীমা, সিরামিকস এবং মিউচুয়াল ফান্ডে বিদেশীদের বিনিয়োগ রয়েছে।
স্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ১৮০ কোটি টাকার বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। বিএটিবিসিতে বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে ২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার। রেনাটায় ২ হাজার ২০২ কোটি টাকা ও গ্রামীণফোনে ১ হাজার ৫২০ কোটি টাকার বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। অলিম্পিকে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা, বেক্সিমকো ফার্মায় ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৩২ কোটি টাকা। ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ে বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে ৬৪৫ কোটি টাকার। ম্যারিকো বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ৩১৮ কোটি টাকা। তাছাড়া সিটি ব্যাংক, আইডিএলসি, বিএসআরএম লিমিটেড, এমএল ডায়িং, সামিট পাওয়ার, বেক্সিমকো, সিঙ্গার বাংলাদেশ, বার্জার, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও সাউথইস্ট ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে।
বিদায়ী বছরের বাজার পরিস্থিতি
২০১৯ সালের প্রথম ১৮ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেড়ে ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে দাঁড়ায়। সদ্য সমাপ্ত বছরের সর্বশেষ কার্যদিবসে ডিএসইএক্স দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৫৩ পয়েন্টে। প্রধান সূচকটি ২০১৮ সালের তুলনায় কমেছে ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। ডিএসইর বাজার মূলধন ২০১৮ সালের ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা থেকে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ৪৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা কমে শেষ কার্যদিবসে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সদ্য সমাপ্ত বছরে দৈনিক গড় টার্নওভার আগের বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ কমে ৪৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সংকটের সূত্রপাত
তারল্য সংকট, আর্থিক বাজারে অনিশ্চয়তা, খেলাপি ঋণ ও সুদহার বৃদ্ধি, কর সংগ্রহে দুর্বলতা ও সরকারি ব্যাংকগুলোয় অত্যধিক ঋণ বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ আগের তুলনায় বেড়েছে। কোম্পানিগুলোর আর্থিক ব্যয় বেড়েছে, একই সঙ্গে কমেছে মুনাফা। দুর্বল বাজার পরিস্থিতিকে আরো সংকটাপন্ন করেছে কোম্পানিগুলোর আয় ও লভ্যাংশের ঘোষণা। সমাপ্ত বছরটিতে বেশির ভাগ কোম্পানি আগের বছরের তুলনায় কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে এবং কমেছে কোম্পানিগুলোর আয়। এদিকে সরকারের সঙ্গে শীর্ষ মূলধনি কোম্পানি গ্রামীণফোনের টানাপড়েন এবং লভ্যাংশ ঘোষণার পর স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারদরে বড় পতনের কারণে বাজার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।
নতুন আইপিও
সদ্য সমাপ্ত বছরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পাঁচ বছরের সর্বনিম্ন তহবিল সংগৃহীত হয়েছে। এক বছরে বাজারে এসেছে নয়টি নতুন কোম্পানি ও একটি মিউচুয়াল ফান্ড। আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে সংগ্রহ করেছে ৬৪০ কোটি টাকা। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে রিং শাইন টেক্সটাইলস, এসএস স্টিল, এসকোয়ার নিট কম্পোজিট, রানার অটো, সিলকো ফার্মাসিউটিক্যালস, জেনেক্স ইনফোসিস ও নিউ লাইন ক্লথিংসসহ আরো কিছু কোম্পানি। আইপিও তহবিলের ৮০ শতাংশই ব্যবহূত হয়েছে কোম্পানি সম্প্রসারণে এবং ১৬ শতাংশ ব্যবহূত হয়েছে ব্যাংকঋণ পরিশোধে।
দরবৃদ্ধির শীর্ষে স্বল্পমূলধনি কোম্পানি
২০১৯ সালে দরবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল স্বল্পমূলধনি কোম্পানিগুলো। আলোচ্য সময়ে দরবৃদ্ধির শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলো হলো স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস, সমতা লেদার, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স ও গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো লিমিটেড।
দরপতনের শীর্ষ কোম্পানি
সমাপ্ত বছরে দরপতনের শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলো হলো ইনটেক লিমিটেড, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, আলহাজ টেক্সটাইল, উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি, ফ্যামিলি টেক্সটাইল, ইফাদ অটোস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলস, মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ও সাফকো স্পিনিং।
শীর্ষ মূলধনি কোম্পানির পারফরম্যান্স
শীর্ষ মূলধনি কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছয়টির বাজার মূলধন কমেছে, বেড়েছে চারটির। বাজার মূলধন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ম্যারিকোর এবং সবচেয়ে বেশি কমেছে আইসিবির। ম্যারিকোর বাজার মূলধন এক বছরে ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে আইসিবির বাজার মূলধন এক বছরে ২৭ দশমিক ৩০ শতাংশ কমেছে।
খাতভিত্তিক পারফরম্যান্স
গত বছর সাধারণ বীমা ছাড়া সব খাতেরই বাজার মূলধন কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে পেপার ও প্রিন্টিং খাতের বাজার মূলধন। খাতটির বাজার মূলধন এক বছরে ৪২ দশমিক ৫৩ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে সাধারণ বীমার বাজার মূলধন এক বছরে ২৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়েছে।
মিউচুয়াল ফান্ড
সমাপ্ত বছরে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ কমেছে। এসব ফান্ড মোট নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে ২৪৩ কোটি টাকা। এছাড়া মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলো ৪১ শতাংশ ডিসকাউন্টে লেনদেন হয়েছে।
শেয়ারবার্তা / হামিদ