আলিফ গ্রুপের কাছে তারল্য সংকটে থাকা বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস লিমিটেডের (বিডি ওয়েল্ডিং) শেয়ার বিক্রি নিয়ে জটিলতার মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। মূলত জেড ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিধিনিষেধ থাকায় এ জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে ছাড় চেয়ে কমিশনের কাছে আবেদন করা হলেও তাতে সাড়া মেলেনি। এ কারণে শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য আইসিবি ও আলিফ গ্রুপের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের ২৮ জুলাই আইসিবির কাছে থাকা বিডি ওয়েল্ডিংয়ের ১ কোটি ৮ লাখ ৪০ হাজার বা ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শেয়ার কেনার জন্য আইসিবির সঙ্গে চুক্তি করে আলিফ গ্রুপ। এক্ষেত্রে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের প্রতিটি শেয়ার ১৫ টাকা ৮৮ পয়সা দরে আইসিবির কাছ থেকে কেনার কথা ছিল আলিফ গ্রুপের। তবে এ বিষয়ে অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে আবেদন করা হলে কমিশন সেটি নাকচ করে দেয়। কারণ কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে, জেড ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ছাড়া অন্য কারো কাছে তাদের শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না। বিডি ওয়েল্ডিং জেড ক্যাটাগরির কোম্পানি এবং আইসিবি কোম্পানিটির পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে আলিফ গ্রুপের কাছে আইসিবির কাছে থাকা বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার বিক্রির সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন বলেন, আলিফ গ্রুপের কাছে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার বিক্রির জন্য আমরা কমিশনের কাছে অনুমোদন চেয়েছিলাম। কিন্তু জেড ক্যাটাগরির কোম্পানির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার নিজেদের বাইরে বিক্রির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকায় কমিশন এক্ষেত্রে অনুমোদন দেয়নি। তবে যদি আলিফ গ্রুপ বাজার থেকে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের ২ শতাংশ শেয়ার কিনে পর্ষদে আসে, তখন তাদের কাছে শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। আমরা তাদের এ পরামর্শ দিয়েছি। এর আগে আলিপ গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষর করা চুক্তির মেয়াদ গত মাসে শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে এটিকে বাড়িয়ে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আলিফ গ্রুপের এক কর্মকর্তা জানান, বিডি ওয়েল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন ও ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস উৎপাদন করে। বাজারে কোম্পানিটির পণ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে। কোম্পানিটির কারখানা সংস্কার করে আবার চালু করা গেলে এটি একটি ভালো বিনিয়োগ হবে বলে আমরা মনে করছি। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকা কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডাররাও উপকৃত হতেন। কিন্তু বিএসইসির পক্ষ থেকে আইসিবিকে শেয়ার অনুমোদন না দেয়ার কারণে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেয়া যায়। এজন্যই আইসিবির সঙ্গে করা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের পক্ষ থেকেও বাজার থেকে শেয়ার কিনে আলিফ গ্রুপকে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের পর্ষদে আসার পর আইসিবির কাছ থেকে শেয়ার কেনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে একসঙ্গে বাজার থেকে ২ শতাংশ শেয়ার কেনা হলে বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারদরে প্রভাব পড়তে পারে। এজন্য আলিফ গ্রুপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ব্লক মার্কেটে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার কেনার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে যাত্রা করা আলিফ গ্রুপের বর্তমানে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, মার্চেন্ট ব্যাংক, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, রিয়েল এস্টেট, গান বাংলা টিভি ও ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটিতে বিনিয়োগ রয়েছে। গ্রুপটির নিজেদের কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হলেও এখন পর্যন্ত দুটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মালিকানা কিনে নিয়েছে তারা। এর মধ্যে ২০১৭ সালে সিএমসি কামালকে কিনে নেয় গ্রুপটি। একই বছর ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) থাকা সজিব নিটওয়্যারকেও কিনে মূল মার্কেটে নিয়ে আসে আলিফ গ্রুপ। পুঁজিবাজারের আরেক সমস্যাগ্রস্ত কোম্পানি সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডকে কিনে নেয়ার জন্য ২০১৭ সালের শুরুতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল আলিফ গ্রুপ। তবে পরবর্তী সময়ে সেই চুক্তি থেকে সরে যায় গ্রুপটি। সর্বশেষ গত বছর স্বল্প মূলধনি কোম্পানি বিডি অটোকারস ও লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে নেয় আলিফ গ্রুপ। এতে কোম্পানি দুটির শেয়ারদর অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিশনের তদন্তে বিডি অটোকারস ও লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির পেছনে আলিফ গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হওয়ায় এ বছরের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় আলিফ গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম, তার স্ত্রী লুত্ফুন নেছা ইসলাম, তার ছেলে গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিমুল ইসলাম, পুত্রবধূ নাবিলা ইসলামসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আলিফ টেক্সটাইল মিলস ও বায়তুল খামুরকে ২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যানুসারে, এ বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিডি ওয়েল্ডিংয়ের ৩১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা-পরিচালকের কাছে, ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, বিদেশীদের কাছে দশমিক ৭২ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৬৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। লোকসান ও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার একটি দুষ্টচক্রে আটকে গিয়েছিল ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোড রড ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস উৎপাদক বিডি ওয়েল্ডিং। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের কারখানার জমি বিক্রি করে ব্যাংকঋণ পরিশোধের পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে ঢাকার ধামরাইয়ে ২ দশমিক ১০ একর জমি কেনে কোম্পানিটি। তবে বর্তমানে অর্থ সংকটের কারণে কারখানাটি চালু করতে পারছে না বিডি ওয়েল্ডিং।
এ বিষয়ে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা বর্তমানে উভয় সংকটে পড়েছি। একদিকে অর্থ সংকটের কারণে কারখানা চালু করতে পারছি না। অন্যদিকে আলিফ গ্রুপ যদি শেয়ার কিনে মালিকানায় আসতে পারত, তাহলে তারা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে এটিকে চালু করতে পারত, কিন্তু সেটিও জটিলতার মধ্যে পড়েছে। আইসিবি ও আলিফ গ্রুপ তাদের চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিষয়টির একটি সমাধান হওয়ার প্রত্যাশায় রয়েছেন বলে জানান তিনি।
১৯৯৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সর্বশেষ ১৫ টাকায় লেনদেন হয়েছে। গত এক বছরে শেয়ারটির সর্বোচ্চ দর ছিল ২২ টাকা ৭০ পয়সা এবং সর্বনিম্ন ১১ টাকা ৮০ পয়সা।
শেয়ারবার্তা / আনিস