উল্টো পথে হাঁটছে দেশের পুঁজিবাজার। নামমাত্র সূচক বৃদ্ধিসহ প্রতিদিনই অপরিবর্তিত থাকছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর। এর মধ্যে যেসব কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে, তার বেশিরভাগ কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে। পুঁজিবাজারকে বড় পতন এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে দ্বিতীয় দফায় শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে এটি নজরে আসছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যা বেশি দেখা গেছে। আলোচ্য সময়ে উৎপাদন বন্ধ থাকা, স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি ও জাঙ্ক শেয়ারের দর কয়েক দফায় বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। অন্যদিকে বহুজাতিক, ভালো লভ্যাংশ দেয়া এবং মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারদর দীর্ঘ সময় ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকতে দেখা গেছে।
মূলত ফ্লোর প্রাইসের কারণে একটি বড় অংশের বিনিয়োগ নানা শেয়ারে আটকে আছে। বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতা না থাকার কারণে সেই শেয়ার বিক্রি করে নতুন করে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে ফ্লোর প্রাইসকে কাজে লাগিয়ে একদল কারসাজি চক্র এই মন্দা বাজারেও প্রতিনিয়ত কারসাজি করে চলেছে বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। কারসাজি চক্র কিছু নির্দিষ্ট জাঙ্ক শেয়ারের দর বৃদ্ধি করছে; পরে বিক্রি করে বের হয়ে গেলে সেই শেয়ারের দর কমে যাচ্ছে। এভাবে এ মন্দা বাজারে কারসাজি চক্র মুনাফা করে চলেছে, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ ফ্লোর প্রাইসের কারণে কিছুই করতে পারছেন না। বরং প্রতিনিয়ত কারসাজির মাধ্যমে বিনিয়োগকরীদের ক্ষতি করছে কারসাজি চক্র।
সম্প্রতি বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিদিনই বেশিরভাগ শেয়ারে ক্রেতা না থাকার কারণে দর অপরিবর্তিত থাকছে। এর অন্যতম করাণে হচ্ছে, বর্তমানে বেশিরভাগ শেয়ারদরই অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে, যা ফ্লোর প্রাইসের কারণে কমতে পারছে না। আর কেউ বিনিয়োগে আগ্রহও দেখাচ্ছেন না। এর মধ্যেই যেসব শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সহজ এবং দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে মুনাফা করা সম্ভব সেসব শেয়ারের দর প্রতিনিয়ত ওঠানামা করছে। এমন কিছু শেয়ারদর পর্যালোচনায় তা দেখা গেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে জুট স্পিনার্স, এমারাল্ড অয়েল, আলহাজ টেক্সটাইল, আজিজ পাইপস, জেমিনি সি ফুড এবং মুন্নু এগ্রোর মতো জাঙ্ক ও স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের মতো বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এর বিপরীতে বাজার মূলধনে সবার শীর্ষে থাকা গ্রামীণফোনসহ ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা এবং
রেনাটার মতো কিছু কোম্পানি ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। যাদের বেশিরভাগ দিন কোনো শেয়ারে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।
আলোচিত শেয়ারগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুট স্পিনার্সের শেয়ারদর গত ছয় মাসে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। শেয়ারটির দর গত ৩০ মে ৪৫৪ টাকা ৯০ পয়সায় পৌঁছে। এরপর কিছুটা কমে সর্বশেষ গতকাল ৪০৯ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়। কিন্তু কোম্পানিটি জেড ক্যাটেগরির। গত কয়েক বছরে কোম্পানিটির কোনো লভ্যাংশ দেয়ার তথ্য ডিএসইর ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। সেই কোম্পানি সর্বশেষ ২০১৬ সালে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করেছে। এরপরও কোম্পানিটির শেয়ারদর এ পর্যায়ে নেয়া হয়েছে কারসাজির মাধ্যমে, যা সম্ভব হয়েছে কোম্পানিটি স্বল্প পরিশোধিত মূলধন হওয়ার কারণে। কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যেখানে কোম্পানির অনুমোদিত মূলধনই হচ্ছে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একইভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর উৎপাদন শুরু করে আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো হতেই এমারাল্ড অয়েলের শেয়ারদর বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। এই কোম্পানির শেয়ারদরও গত ছয় মাসে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। ফলে কোম্পানির শেয়ারদর ছয় মাসে ৩১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে গতকাল হয়েছে ১৮২ টাকা ৫০ পয়সা, যা সাড়ে ৫ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কোম্পানিটিও জেড ক্যাটেগরির। এদিকে সর্বশেষ আর্থিক বছরে মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে এ ক্যাটেগরিতে থাকা জেমিনি সি ফুড এবং মুন্নু এগ্রোর শেয়ারদর কারসাজির মাধ্যমে বৃদ্ধি করে নেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কোম্পানি দুটি স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি। ফলে আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও কোম্পানিকে ১০ শতাংশ হারে বেশি লভ্যাংশ দিতে হয় না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারসাজি চক্র শেয়ার দুটির দর নিয়ে প্রতিনিয়ত কারসাজি করে চলেছে। এর মধ্যে জেমিনি সি ফুড নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত কমিটি গঠন করলেও, শেয়ারটিতে কারসাজি থামেনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে তোয়াক্কা না করেই চলে কারসাজি। এর মধ্যে জেমিনি সি ফুডের শেয়ার ছয় মাসে বাড়িয়ে ৭ মে ৯৩৪ টাকা ৪০ পর্যন্ত নেয়া হয়। পরে কিছুটা কমে গতকাল এর দর ৮০১ টাকা ৭০ পয়সায় দাঁড়ায়। মুšুœ এগ্রোর শেয়ারদর ছয় মাসে বাড়িয়ে ১৪ জুন সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৩১ টাকা ৭০ পয়সায় নেয়া হয়েছে। এরপর কমে গতকাল শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ৯৯৯ টাকা ৭০ পয়সায়।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে কারসাজি চক্রের আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনিয়োগকারীর পুঁজি নিরাপদ না হলে ফ্লোর প্রাইস তোলা হবে না, এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে কারসাজি চক্র। ফলে নির্দিষ্ট পচা শেয়ারের দর বৃদ্ধি ও কমানোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মুনাফা করে নিচ্ছে তারা। এই কারসাজির মাঝে কিছু বিনিয়োগকারী নামমাত্র মুনাফা করলেও বেশিরভাগ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। আর কারসাজি চক্রের মুনাফাকে ফ্লোর প্রাইসে থাকা এই মন্দা বাজারে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা বলে দাবি করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেকে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবেন। সেই সঙ্গে বাজারের প্রতি আস্থা সংকট মহামারি আকার ধারণ করবে। তাই কারসাজিকারীদের সুযোগ না দিয়ে বিনিয়োগকারীদের নিয়ে নিয়ন্ত্রকের সঠিকটা ভাবতে হবে বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এক ব্রোকরেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে জানান, বর্তমানে বাজারে কারসাজি ছাড়া কোনো শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। হাতেগোনা কয়েকটি শেয়ারের দর বৃদ্ধি পায়। আর বেশিরভাগ শেয়ার আটকে থাকে ফ্লোর প্রাইসে, যার মধ্যে অধিকাংশই মৌলভিত্তি শেয়ার। এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইস দেয়ার কারণে। বাজারের ধর্মই হচ্ছে শেয়ারের দর ওঠানামা করা। শেয়ারদর না কমলে কেউ কিনবে না। কারণ শেয়ারদর কমলে বিনিয়োগ করে তার দর বৃদ্ধিতে মুনাফা হবে। তাই এভাবে ফ্লোর দিয়ে আটকে না রেখে বাজারের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। আর বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষায় কারসাজিকারীদের বাজার থেকে বের করে দিতে হবে বলে জানান তিনি।