দুই মাস আগে আলোচিত এমারেন্ড ওয়েলের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩০ টাকার নিচে। দুই মাসের ব্যবধানে শেয়ারটি প্রায় সাড়ে চার গুণ বেড়ে লেনদেন হচ্ছে ১৩০ টাকার ওপরে। এখন শেয়ারটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে নানা কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দফায় ডিভিডেন্ডও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কিছুতে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারটির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা যায়, গত ৩ জুন কোম্পানিটি ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এরমধ্যে ২০২০ ও ২০২১ অর্থবছরের জন্য ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করেছে। ২০২২ অর্থবছরের জন্য কেবল সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ২ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে।
কিন্তু এতে শেয়ারটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। ফলে শেয়ারটির দর পড়ে যায়। এরপর তড়িঘড়ি করে চার দিনের মাথায় কোম্পানিটি ২০২৩ অর্থবছরের জন্য ৫ শতাংশ অন্তবর্তী ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। কিন্তু এতেও শেয়ারটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি। কারণ শেয়ারটির দর ইতোমধ্যে আকাশে তোলা হয়েছে এবং শেয়ারটির সিংহভাগই কারসাজিকারিরা তাদের কব্জায় নিয়েছেন। এখন নিজেরা নিজেরা লেনদেন করে শেয়ারটির লেনদেন বড় করে দেখানো হচ্ছে, যাতে শেয়ারটির লেনদেন দেখে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হয়-এমনই মন্তব্য করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
এমারেন্ড ওয়েলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভোজ্য তেল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৮ সালে এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তালিকাভুক্তির তিন বছরের মাথায় ২০১৭ সালে কোম্পানিটি বড় রকম সঙ্কটে পড়ে এবং মালিকদের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
উৎপাদন বন্ধ থাকার চার বছর পর মিনোরি বাংলাদেশে নামের একটি জাপানি ফার্মিং কোম্পানি যা মিনোরি কোম্পানি লিমিটেড এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান-এমারল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কিনে নেয়।
২০২১ সালে মিনোরি বাংলাদেশ নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদন শুরু করার ঘোষণা দেয়। তারপর বার বার উৎপাদনের তারিখ পরিবর্তন করে। অবশেষে ২০২২ সালের ০৯ জানুয়ারি কোম্পানিটির আংশিক উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু উৎপাদন শুরুর পর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদন বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের কোনো তথ্য দেয়নি।
এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আফজাল হোসেন উৎপাদন শুরুর প্রাক্কালে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তেল উৎপাদনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তেল উৎপাদনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি থাকলেও গ্যাস সংকটের কারণে আগে তা সম্ভব হয়নি। যদিও প্রয়োজনীয় গ্যাস সংযোগ ছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল কারণে পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও জানান, একটানা ২৪ ঘন্টা গ্যাসের প্রয়োজন হয়, তবে তা পাওয়া যায় না। মাত্র পাঁচ ঘন্টা গ্যাসের সরবরাহ রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করা হবে। এলপিজি গ্যাস সংযোগ সম্পন্ন হয়েছে। উৎপাদন পুরোদমে শুরু হবে।
কিন্তু পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন শুরুর আগেই কোম্পানিটির দর হু হু করে বেড়ে যায়। লাগামহীন দর বৃদ্ধির অবস্থা দেখে মনে হয়েছে শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি করার জন্যই এতসব আয়োজন হয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা এই কারসাজিতে ইন্ধন যুগিয়েছেন। তা না হলে এভাবে লোকসানী ও নেগেটিভ সম্পদ মূল্যের একটি কোম্পানির শেয়ারদর এভাবে লাগামহীনভাবে বাড়তে পারে না।
কোম্পানিটির শেয়ারদর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে এমারেন্ড ওয়েলের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮ টাকা ৫০ পয়সায়। সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১৩৬ টাকার ওপরে। শেয়ারটির দর বেড়েছে ১০৭ টাকার বেশি বা ৩৭৭ শতাংশের বেশি।
এর আগে ওরিয়ন ইনফিউশনের দরও কারসাজিকারিরা ৭৬ টাকা থেকে হাজার টাকায় তুলেছিল। তখনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা উদাসীন ছিল। গণমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘুম ভাঙ্গেনি। এখন ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার ৩৫০ টাকার নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। যারা হাজার টাকায় শেয়ারটি কিনেছিল, তারা এখন দিশেহারা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমারেন্ড ওয়েলের শেয়ারেরও এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। যারা চড়া দরে কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগ করবে, তাদেরকেও ওরিয়ন ইনফিউশনের বিনিয়োগকারীদের মতো দিশেহারা হতে হবে। কারণ নেগেটিভ রিজার্ভের কোম্পানিটি যেভাবে বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর জন্য অবাঞ্চিত ড্রামা শুরু করেছে, ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের জন্য তা কতোটা ভয়ঙ্কর হবে, তা সহজেই অনুমেয়। ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাচাই করে শেয়ারটিতে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।