ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের বিপুল বিক্রয়াদেশে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। ফলে দুর্বল ভিত্তির শেয়ারের পাশাপাশি এসব কোম্পানির শেয়ারও আটকে আছে ফ্লোর প্রাইসে। বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখছে বিএসইসি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অধিক সংখ্যক শেয়ারের কৃত্রিম বিক্রয়াদেশ দানকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার। কিছু শেয়ারে কৃত্রিম বিক্রয়াদেশ দিয়ে ওইসব শেয়ার কেনায় প্রলুব্ধ করছে কারসাজি চক্র। এ ব্যাপারে কঠোর হচ্ছে বিএসইসি।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, ধারাবাহিক দরপতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ৩১ জুলাই ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্নদামের সীমা বেঁধে দেয় কমিশন। পরবর্তী দুই মাস লেনদেনে বড় উত্থানের পাশাপাশি সূচক ছিল ইতিবাচক। কিন্তু অক্টোবর থেকে শুরু হয় ফের নিম্নমুখী প্রবণতা। এই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারে লেনদেন কমে তলানিতে নেমে আসে। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হয় মাত্র ১৪৬ কোটি টাকা। যা ছিল কোভিড-পরবর্তী সময়ের সর্বনিম্ন লেনদেন।
ডিসেম্বরে লেনদেন এতটাই কমে আসে যে, ৩৯২টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩০০টির বেশি শেয়ার ও ফান্ড ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকে। যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষণীয় ছিল বড়সংখ্যক বিক্রেতার চাপ।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, ‘লেনদেন শূন্যতার মাঝেও যারা অধিকসংখ্যক শেয়ারের বিক্রয়াদেশ দিচ্ছেন, তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে কমিশন। পর্যালোচনা করে দেখা হবে, বিক্রয়াদেশ দেওয়া শেয়ারগুলো ম্যাচিুউর ছিল কি না, থাকলে কী উদ্দেশ্যে অধিকসংখ্যক শেয়ার বিক্রয়াদেশ দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে যদি বাজারকে প্রভাবিত করা বা সন্দেহজনক বিক্রয়াদেশ পাওয়া যায়, তবে ওই বিনিয়োগকারীকে শোকজ করা হবে। কোনো ব্যত্যয় থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত বুধবার ডিএসইর বাজার মূলধনের দিকে বড় ১০টি কোম্পানির সারা দিনের লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড বাদে সব কোম্পানির শেয়ারই ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। কারণ সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বড় ধরনের বিক্রয়াদেশ আসে এসব শেয়ারের।
বাজার মূলধনে সবচেয়ে কোম্পানি গ্রামীণফোন ফ্লোর প্রাইস ২৮৬ টাকা ৬০ পয়সা লেনদেন হচ্ছে। সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর মিনিটখানেকের মধ্যে ৫ লাখের অধিক শেয়ার বিক্রয়াদেশ আসে ডিএসইর অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (ওএমএস)। কিন্তু দিনশেষে বেচাকেনা হয়েছে ২৭৭টি শেয়ার।
সংকটময় পরিস্থিতিতেও ভালো মুনাফা করা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারেও বিক্রয়াদেশের চাপে ফ্লোর প্রাইস ৫১৮ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে। এখানেও দেখা যায় দিনের শুরুতে প্রায় ৫ লাখ শেয়ারের বিক্রয়াদেশ দেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১২৬টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
ওষুধ খাতের দেশীয় নামি ব্র্যান্ড স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালের শেয়ারও ফ্লোর প্রাইস ২০৯ টাকা ৮০ পয়সায় আটকে আছে। সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে সারা দিনে লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ৬২৬টি শেয়ার। বিপরীতে শেয়ারের বিক্রয়াদেশ ছিল ১০ লাখের বেশি। টেলিকম খাতের রবি আজিয়াটা লিমিটেডের শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ৩০ টাকায় অনেকদিন ধরেই লেনদেন হচ্ছে। সারা দিনে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৪১১টি শেয়ার। কিন্তু শেয়ারটির বিক্রয়াদেশ ছিল ৩৩ লাখের ওপরে। জ্বালানি খাতের ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির শেয়ারও দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে।
শেষ কার্যদিবসে সারা দিনে লেনদেন হয়েছে মাত্র ২১টি শেয়ার। অথচ শেয়ারটির বিক্রয়াদেশ ছিল ২ লাখের ওপরে। এই শেয়ারটির ফ্লোর প্রাইস ২৩৩ টাকা ৭০ পয়সায়। পুঁজিবাজার চাঙ্গা থাকা অবস্থায় সব সময় লেনদেনের শীর্ষ পাঁচে থাকে বিবিধ খাতের বেক্সিমকো লিমিটেড। কিন্তু বুধবার সারা দিনে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২২২টি শেয়ার।
এর বিপরীতে শেয়ারটির বিক্রয়াদেশ ছিল ৮৯ লাখের বেশি। বেক্সিমকোর ফ্লোর প্রাইস ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা। গত কয়েক বছর ধরে ভালো মুনাফা করা সিমেন্ট খাতের লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডও ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। সারা দিনে ১১ হাজার ৩০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। কিন্তু বিক্রয়াদেশ ছিল ১১ লাখের ওপর। শেয়ারটির ফ্লোর প্রাইস ৬৪ টাকা ৮০ পয়সা।
বাজার মূলধনে শীর্ষ ১০টি কোম্পানির মধ্যে শুধু বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশের শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসের ওপরে অবস্থান করছে। শেয়ারটির ফ্লোর প্রাইস ১ হাজার ৭১১ টাকা ৬০ পয়সা। কিন্তু সবশেষ লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭২০ টাকা ৯০ পয়সায়। কারণ এই শেয়ারটির বিক্রির চাপ তুলনামূলক অনেক কম।
বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে খুব একটা লেনদেন না হলেও বড় ধরনের বিক্রয়াদেশ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলেছেন, এ ধরনের বিক্রয়াদেশের কারণে অনেকে শেয়ার কিনতে ভয় পাচ্ছেন। ফলে লেনদেন হচ্ছে যৎসামান্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, কারা লেনদেনের শুরুতে লাখ লাখ শেয়ারের বিক্রয়াদেশ দেন তা তদন্ত করে দেখা উচিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার। কারণ সব শেয়ারকে একটি নির্দিষ্ট দামে আটকে রেখে কারসাজি চক্র কয়েকটি শেয়ার কেনায় প্রলুব্ধ করার জন্য এমন কাজ করতে পারে।