বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও স্থিতি গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই এ ঋণ বাড়ছে। গত দুই অর্থবছর (২০২০-২১ ও ২০২১-২২) দেশে বৈদেশিক ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এক দশকে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২২৭ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ দ্রুত বাড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা বিপদে পড়েছে। যদিও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে; তবে একেবারে ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বেসরকারি একটি গবেষণা সংস্থা। ‘ইজ বাংলাদেশ মিররিং শ্রীলঙ্কা অ্যান্ড পাকিস্তান?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার গত এক দশকের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির চিত্র এবং বৈদেশিক ঋণ ও জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতের তুলনা তুলে আনা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর জুনশেষে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। পরের (২০১৩-১৪) অর্থবছর তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ আরও কিছুটা বেড়ে হয় ৩৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছর তা ৪০ বিলিয়ন ও ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
পরের অর্থবছর তা এক লাফে রেকর্ড ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাড়ে। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা আরও বেড়ে হয় ৬২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ৬৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ রেকর্ড ১৩ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায়। ওই অর্থবছর জুনশেষে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ আবারও রেকর্ড বৃদ্ধি পায়। ওই সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এতে গত জুনশেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
যদিও অর্থনেতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, গত অর্থবছর বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে মাত্র সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। তবে বেসরকারি ঋণের কোনো হিসাব সংরক্ষণ করে না ইআরডি। সংস্থাটির হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছর জুনশেষে সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছর তা বেড়ে হয়েছে ৬৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলেÑসেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শেয়ার বিজকে বলেন, ইআরডি থেকে প্রকাশিত বৈদেশিক ঋণের তথ্যে এক ধরনের গোঁজামিল রয়েছে। মোট ঋণের ৯৪ শতাংশই প্রকল্প ঋণ ও বাজেট সহায়তা হিসেবে এসেছে। কিন্তু এ ঋণের মধ্যে কতটুকু পরিমাণ কঠিন শর্ত আর কতটুকু সহজ শর্তের, সে বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়নি।
২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪ বিলিয়ন ডলার নতুন বৈদেশিক ঋণ দেশের পোর্টফোলিওতে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি তো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এমনিতেই বেশকিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। তার মধ্যে যদি এই মাত্রায় ঋণ বাড়তে থাকে, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আর স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে না। পরবর্তী সরকারের জন্য এ ঋণ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এক দশক আগে ২০১২-১৩ অর্থবছর শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে দেশটির বৈদেশিক ঋণ প্রতি বছর একটু একটু করে বেড়েছে। এতে গত অর্থবছর শেষে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশটির বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে মাত্র ৬১ শতাংশ। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ছিল সর্বোচ্চ ৫৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের বছর তা কমিয়ে আনা হয়।
এদিকে পাকিস্তানে এক দশক আগে ২০১২-১৩ অর্থবছর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। পরের দুই বছর পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ ধীরগতিতে বেড়েছে। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে দেশটির বৈদেশিক ঋণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এতে গত অর্থবছর শেষে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশটির বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ১১৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ছিল সাড়ে ১৭ শতাংশ। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর তা সাড়ে ১৫ শতাংশে নেমে আসে। এরপর থেকে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত একটু একটু করে বাড়ছে। গত অর্থবছর শেষে এ অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। গত অর্থবছর শেষে শ্রীলঙ্কায় এ অনুপাত দাঁড়ায় ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৬০ শতাংশ।
যদিও বাংলাদেশ এখনও বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে মনে করছে আইএমএফ। বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে গত মাসে সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি-সংক্রান্ত চাপ (রিস্ক অব এক্সটার্নাল ডেট ডিসট্রেস) এখনও নিম্নে।