পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর ২০১১ সালে এ-সংক্রান্ত বিধান করে বিএসইসি। তবে ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিধান অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। আর প্রত্যেক পরিচালককে এককভাবে ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। ২০১১ সালে এমন আইন করা হলেও সেটি পরিপালনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণে আইন করার পরও তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি ন্যূনতম শেয়ার ধারণের শর্ত মেনে আসছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের ২১ মে বিএসইসির ৬৮৭তম সভায় ন্যূনতম শেয়ার ধারণসংক্রান্ত আইনটি পরিপালন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর সময় বৃদ্ধি করার পরও অনেক কোম্পানি ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকের শেয়ার ধারণ করেনি। এ কারণে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০টি কোম্পানির পর্ষদ সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে চারটি কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বিএসইসি। পর্ষদ পুনর্গঠন না হওয়া বাকি ১৬টি কোম্পানি হচ্ছে অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস (এএফসি), অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ডেল্টা স্পিনার্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফাইন ফুডস, ফু-ওয়াং সিরামিক, ফু-ওয়াং ফুডস, জেনারেশন নেক্সট, ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক, মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, ফার্মা এইডস, সালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ।
উল্লিখিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস ৩১ মার্চ ২০২২ সালে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ১২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ধারণ করছে। অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স প্রিমিয়ামসহ ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে ২২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। ঋণে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে উৎপাদন বন্ধ। পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ ধারণ করছে। সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস ওষুধ ও রসায়ন খাতের প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রথম বছর নগদ লভ্যাংশ দেয়। এরপর চার বছর বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি বিনিয়োগকারীদের। কোম্পানিটি সর্বশেষ উদ্যোক্তা ও পরিচালককে মোট শেয়ারের ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ ধারণ করছে। বস্ত্র খাতের কোম্পানি ডেল্টা স্পিনার্স সর্বশেষ ২০১৪ সালে পুঁজিবাজার থেকে রাইট শেয়ার ছেড়ে ৯১ কোটি ৭২ লাখ টাকা সংগ্রহ করার পরও বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। বিপুলসংখ্যক বোনাস শেয়ার দেয়ায় ১৭৫ কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধনের কোম্পানিটি পরিশোধিত মূলধন ১৬৬ কোটি ৪৮ লাখ ১ হাজার ৯৬৪ টাকা। পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ ধারণ করছে।
আলোচিত ব্যাংকার পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের যোগসাজশে ফাস ফাইন্যান্স থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে। কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে জামানত ছাড়াই ঋণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ ধারণ করছে। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ফাইন ফুডসের বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ৯ দশমিক ০৮ শতাংশ ধারণ করছে। ফু-ওয়াং সিরামিকের বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ২৫ দশমিক ০২ শতাংশ ধারণ করছে। জেনারেশন নেক্সটের বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ ধারণ করছে। ফু-ওয়াং ফুডসের বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ ধারণ করছে।
ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কের বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ ধারণ করছে। মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িংয়ের বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ ধারণ করছে। নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ১৫ দশমিক ০৯ শতাংশ ধারণ করছে। ফার্মা এইডস বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ২৪ দশমিক ২২ শতাংশ ধারণ করছে। সালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ২৪ দশমিক ২২ শতাংশ ধারণ করছে এবং সুহƒদ ইন্ডাস্ট্রিজ বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ১২ দশমিক ০১ শতাংশ ধারণ করছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের নিচে থাকা কোম্পানির সংখ্যা ছিল অনেক। সেখান থেকে অনেকটা কমিয়ে আনা হয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা রয়েছে। সে জন্য কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এমন কোনো আক্রমণাত্মক ভূমিকায় যেতে চাই না, যাতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে দ্রুত এখান থেকে উত্তোলন করা যায়।’